“এমনকি বড়রাও দেখে প্রথমে চিৎকার করলেও একটু পরেই ধরে ফেলেছিল যে জিনিসটা মিট সস। তারপর তারা হেসে ফেলত। আমরা এরকম কান্ডকারখানা অনেক করেছি আগে, প্রতিবেশিরা সবাই জানত আমাদের শয়তানি।”
“কোন গাড়ি যায়নি?”
যেহেতু ওখানে আগে ট্রাফিক অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছিল, তার মানে কোন না কোন সময় তো সেখান দিয়ে গাড়ি যাওয়ার কথা। আর ইয়ু রাস্তায় পড়েছিল, বিপদ হতে পারত।
আমি যখন প্রশ্নটা করলাম, মোরিনো কোন অনুভূতি না প্রকাশ করে বলল, “একটা গাড়ি এসেছিল। ইয়ু চোখ বন্ধ করে ছিল তাই টের পায়নি। গাড়িটা ওর সামনে এসে কষে ব্রেক করে থেমেছিল। গাড়ি থামার শব্দে ইয়ু উঠে বসেছিল। মুখ থেকে সস মুছে তাকিয়ে দেখে মুখের সামনে গাড়ির বাম্পার। বাম্পারটা সিলভার পলিস করা ছিল, ওর চেহারার প্রতিফলন সেখানে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল..”
“তুমি ওকে ডেকে সাবধান করে দাওনি?”
“না। দেখতে চাইছিলাম কি হয়।” আমি ওর কথার সুরে অপরাধবোধের চিহ্ন খুঁজলাম, কোন চিহ্ন পেলাম। ওর এরকম কোন বৈশিষ্ট্য নেই। একদিক থেকে বললে সে এই ক্ষেত্রেও আমার মতই অনেকটা।
“আমরা যমজ, তাই দেখতে একইরকম ছিলাম। আমাদের চিন্তাভাবনায়ও অনেক মিল ছিল। কিন্তু আমাদের ব্যক্তিত্বের মধ্যে কিছুটা পার্থক্য ছিল। আমার বোন ছিল দূর্বল প্রকৃতির।”
আমরা যেখানে বসে ছিলাম তার সামনে একটা বাস এসে থামল। আমাদের জন্য অপেক্ষা করে চলে গেল আর পেছনে ফেলে গেল ধোঁয়ার একটা গন্ধ।
সূর্য দিগন্তের কাছে নেমে গেলে পুব আকাশ অন্ধকার হতে শুরু করেছিল। বাতাসে গার্ডরেইলের ওপারের শুকনো ঘাসগুলো কাঁপছিল।
মোরিনো বেঞ্চে নিচু হয়ে বসেছিল। ওহ হাতগুলো হাঁটুর উপর রাখা।
“আমরা অনেকটা সময় ধরে মৃত্যুর কথা চিন্তা করতাম। মৃত্যুর পর আমরা কোথায় যাব? তখন কি হবে আমাদের? এইসব চিন্তা-ভাবনা আমাদের কাছে খুব আকর্ষণীয় লাগত তখন। কিন্তু আমার মনে হয় ইয়ুর চেয়ে আমি মৃত্যু সম্পর্কে বেশি জানতাম। আর আমি ওরচেয়ে একটু বেশি নিষ্ঠুর ছিলাম।”
কোন অনুভূতি প্রকাশ না করে মোরিনো আমাকে বলল কিভাবে সে ইয়ুকে বিভিন্ন কাজ করতে আদেশ করত।
“সে সময় আমাদের ছাউনিতে একটা প্রাণী ছিল। চারপেয়ে, মুখ দিয়ে লালা ঝরত, দুর্গন্ধওয়ালা-বুঝতেই পারছ কিসের কথা বলছি।”
আমি ধরে নিলাম ও কুকুরের কথা বলছে। ওর একটা পোষা কুকুর ছিল শুনে আমার বিশ্বাস হচ্ছে না।
“আমি ইয়ুকে আদেশ করলাম ওটার খাবারে ব্লিচ মিশিয়ে দিতে। এমন যে আমি ভাবছিলাম ওটার গায়ের রং সাদা হয়ে যাবে বা সেরকম বোকা ধরনের কিছু। আমি স্রেফ ওটাকে কষ্ট পেতে দেখতে চাইছিলাম।”
ইয়ু ইয়োরুকে থামতে অনুরোধ করেছে।
“কিন্তু আমি শুনিনি, আমি ওকে দিয়ে জোর করে কুকুরের খাবারে ব্লিচ মেশালাম। সে চায়নি কিন্তু আমি ওকে এড়িয়ে যেতে দেইনি।”
ব্লিচ খেয়ে কুকুরটা মরল না। কিন্তু দুদিন সাতিক অসুস্থ হয়ে পড়ে থাকল। মোরিণোর বাবা-মা আর নানা-নানি কুকুরটার যত্ন নিল। সারাটা দিন আর সারারাত কুকুরটা যন্ত্রণায় মোচড়াল আর আর্তনাদ করল। ওর চিৎকার পর্বতে প্রতিধ্বনি তুলত।
ইয়োরু পুরো ব্যাপারটা মনোযোগ দিয়ে লক্ষ্য করল। কিন্তু ইয়ু খুব ভয় পেয়েছিল। সে সারাদিন ঘরের ভেতর থাকল, দু-হাত দিয়ে কান চেপে।
“ইয়ু অনেক কেঁদেছিল।”
ইয়োরু কুকুরের সাথে সাথে তার বোনকেও ভালোমত লক্ষ্য করল। নিজে সরাসরি কুকুরটাকে ব্লিচ না খাইয়ে সে সমস্ত অপরাধবোধ তার বোনের উপর চাপিয়েছিল। ইয়োরুর পরীক্ষায় কুকুর আর তার বোন দু জনেই যন্ত্রণা পেয়েছিল।
ইয়োরু আর ইয়ু নিজেরাও গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা আত্মহত্যা খেলত, একবারই খেলেছিল।
“ঠিক করে বললে, এক কদমের জন্য আমাদের আত্মহত্যা আটকে গিয়েছিল। সেদিন বৃষ্টি হচ্ছিল। যে কারনে বাইরে খেলতে যেতে পারিনি, ছাউনিতে খেলছিলাম। ইয়ু মারা যাওয়ার এক কি দুই মাস আগের ঘটনা এটা।”
যমজ বোন দু-জন প্রত্যেকে মেঝের উপর একটা করে কাঠের বাক্স রেখে তার উপর দ্বিতীয় আরেকটা বাক্স রেখে দাঁড়াল। ছাউনির বিম থেকে ঝুলানো দড়ি গলায় দিল। এরপর স্রেফ বাক্স থেকে লাফ দিয়ে ফাঁস খেয়ে মরা বাকি।
“আমি বললাম তিন পর্যন্ত গুনে আমরা লাফ দিব। মিথ্যে বলেছিলাম আমি, লাফ দিতাম না। ইয়ু ফাঁস খেয়ে মরত আর আমি দেখতাম।”
এক…দুই…তিন। তিন গোনার পর দু-জনের কেউই লাফ দিল না। দু জনেই চুপ করে ছিল।
“ইয়ু বুঝতে পেরেছিল আমি কি ভাবছিলাম, যে কারনে সে লাফ দেয়নি। আমি যখন ওকে জজ্ঞেস করলাম কেন লাফ দেয়নি, ও স্রেফ সেখানে দাঁড়িয়ে থেকে ভয়ে কাঁপছিল।”
ইয়ু মুখ খুলে বলতে পারেনি কেন পুরো ব্যাপারটা অন্যায় ছিল, সে শুধু দাঁড়িয়ে থেকে ইয়োরুর অপমানের বন্যায় ভেসে গেল।
“তুমি ইয়ুকে বুলি করতে?”
“সেটা বলা যেতে পারে। কিন্তু সে সময় আমার কোন হুশ ছিল না। বেশিরভাগ সময়ই আমাদের মধ্যে কোন সমস্যা হত না। আর ইয়ু ওর ভাগের খারাপ কাজগুলোও ঠিকমত করত। আমার চেয়ে ও আরো ভালো মত মরার অভিনয় করে লোকজনকে আতংকিত করতে পারত।”
“তোমার পরিবারের অন্যরা জানত তোমাদের দুই বোনের মধ্যে সম্পর্ক যে এরকম ছিল?”
“না।”
মোরিনো নিরব হয়ে সামনের রাস্তার দিকে তাকিয়ে থাকল। শাঁ করে একটা গাড়ি ছুটে গেল। চারপাশ অন্ধকার হয়ে আসায় গাড়িটার হেড লাইট জ্বালানো ছিল। বাতাসে মোরিনোর চুল উড়ছে, কয়েকটা চুল আবার গালের সাথে লেপ্টে আছে।