এই সময় মোরিনো একটা দুর্দান্ত কথা বলল। “তামাকের কারনে অনেক মানুষ মারা যায়, কিন্তু সিগারেটের ভেন্ডিং মেশিন এই বুড়ির কাজ কেড়ে নিয়ে তাকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিচ্ছে।”
ও আমার থেকে কোন প্রতিক্রিয়া আশা করছিল না, তাই আমিও কিছু বললাম না।
আমরা রাস্তার ধার দিয়ে হেঁটে সোবা শপের দিকে গেলাম। রাস্তাটা পাহাড় ঘিরে উপরের দিকে উঠে গিয়েছে।
স**** মাউন্টেনের গোড়ায় সোবা শপটা দাঁড়িয়ে। পাশে সারি দিয়ে কয়েকটা রেস্টুরেন্ট আর বার। তেমন একটা ভিড় ছিল না, অল্প কয়েকটা গাড়ি আর লোকজন দেখা গেল। সোবা শপের পার্কিং লটে কোন গাড়ি ছিল না। অবশ্য দোকানটা ভোলাই ছিল, দরজায় ‘ওপেন দেখে আমরা ভেতরে গেলাম।
“খুনির সাথে মিজুগুশি নানামির এখানেই দেখা হয়েছিল,” মোরিনো বলল। দোকানের ভেতরে এমনভাবে চোখ বোলাল, যেন আমরা জনপ্রিয় কোন টুরিস্ট স্পটে এসেছি। “সরি-এটা আসলে একটা সম্ভাবনা, সে হয়তো এখানে মেয়েটার সাথে দেখা করেছিল। আমরা এখানে এসেছি সত্যিটা কি তা জানতে।”
আমি ওর কথায় পাত্তা না দিয়ে নোটবুক পড়তে লাগলাম। নীল বল পয়েন্ট কলমে লেখা। নোটবুকে শুধু যে তৃতীয় মেয়েটার কথা ছিল, তা নয়। আরও কিছু মাউন্টেনের নাম লেখা ছিল। প্রথম পৃষ্ঠায় সেগুলো লেখা ছিল খুনের কাহিনীগুলোর আগে।
মাউন্টেনগুলোর নামের সাথে এরকম চিহ্ন দেয়া ছিল : ⃣,O,⃤ /, আর X। যে মাউন্টেনগুলোতে লাশ তিনটা রাখা হয়েছে সেগুলোর সবগুলোতে • দেয়া। হয়তো এর মানে হল এই মাউন্টেনগুলো খুন করার জন্য সবচেয়ে ভালো জায়গা।
নোটবুকে এমন কিছু ছিল না যা থেকে লেখক সম্পর্কে কিছু জানা যায়। আর আমাদের দুজনের কেউই এটা পুলিশের হাতে তুলে দেয়ার কথা চিন্তাও করিনি। আমরা কিছু করি না করি পুলিশ আজকে হোক কালকে হোক খুনিকে একদিন ধরবেই। নোটবুক ওদের দিলে হয়তো কাজটা একটু দ্রুত হতে পারে, ভিক্টিমের সংখ্যা কমতে পারে। সুতরাং আমাদের দায়িত্ত নোটবুকটা পুলিশের হাতে তুলে দেয়া। কিন্তু দুঃখজনকভাবে আমাদের সেসব নিয়ে কোন মাথা ব্যথা ছিল না। আমরা নিষ্ঠুর, সরীসৃপের মত হিংস্র, হাই স্কুলের শিক্ষার্থী।
“যদি চতুর্থ কোন ভিক্টিম পাওয়া যায়, তাহলে ধরে নিতে হবে আমরাই তাকে খুন করেছি।”
“কী দুঃখজনক।”
সোবা খেতে খেতে আমরা এইসব আলাপ করলাম। মোরিনোকে দেখে মনে হচ্ছিল না ওর কাছে ব্যাপারটাকে দুঃখজনক কিছু মনে হচ্ছে, ওর কথায় অনুভূতির কোন রেশ ছিল না, সমস্ত মনোযোগ ছিল সামনে বাটি ভর্তি সোবার উপর।
দোকানের মালিকের কাছে আমরা মঠে যাওয়ার রাস্তা জানতে চাইলাম।
আমরা যখন হাঁটছিলাম, মোরিনো তখন নোটবুকের দিকে তাকিয়ে ছিল, কাভারে স্পর্শ করছিল, যেখানে কিনা খুনিও স্পর্শ করেছে। ওর
ভাবসাবে মনে হল খুনির প্রতি ওর যথেষ্ট পরিমান ভক্তিও আছে।
আমার নিজেরও আছে। জানি ব্যাপারটা সঠিক নয়। খুনি এমন একজন ব্যক্তি যার শাস্তি হওয়া উচিত। তাকে এমন মর্যাদা দেয়া উচিত না যেভাবে একজন বিপ্লবী কিংবা শিল্পীকে মর্যাদা দেয়া হয়। একই সাথে এও জানি যে কিছু মানুষ আছে যারা কুখ্যাত খুনিদের রীতিমত পুজা করে-আর সেরকম কোন একজনে পরিণত হওয়া নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয় কোন ব্যাপার না।
নোটবুকের মালিকের বিভৎস কৃতকর্ম আমাদের পুরোপুরি আয়ত্ত করে ফেলেছিল। এই খুনি সাধারণ জীবনের সীমা অতিক্রম করে কিছু মানুষকে শারীরিকভাবে ধ্বংস করে ফেলেছে। তাদের পরিচয়, তাদের সম্মান নষ্ট করে ফেলেছে। দুঃস্বপ্নের মাঝে আটকে পড়া অবস্থা হয়েছিল আমাদের, অন্য দিকে দৃষ্টি ফেরাতে পারছিলাম না।
সোবা শপ থেকে মঠে যেতে পাহাড় বেয়ে কিছুদূর উঠতে হলো আমাদের, তারপর বিশাল এক সিঁড়ি বেয়ে আরো উপরে যেতে হলো।
যে কোন ধরনের ব্যায়ামের প্রতি আমাদের দুজনেরই অন্যরকম এক ঘৃণা রয়েছে। নিচে নামা কিংবা উপরে ওঠা কোনটাই আমাদের পছন্দ ছিল না। যেকারনে মঠ পর্যন্ত পৌঁছতে গিয়ে আমরা হাঁপিয়ে গেলাম।
মঠের মূর্তিগুলোর নিচে বসে কিছুক্ষণ বিশ্রাম করলাম। আশেপাশে খালি গাছ আর গাছ। গাছগুলোর ডালপালা আমাদের মাথার উপর ছড়িয়ে ছিল, পাতার ফাঁক দিয়ে গ্রীষ্মের সূর্য উঁকি দিচ্ছিল।
আমরা দু-জন পাশাপাশি বসে ছিলাম, চারপাশ থেকে পোকার ঝিঁঝি শব্দ কানে আসছিল।
মোরিনোর কপালে ঘাম জমে গেছে।
একসময় সে ঘাম মুছে উঠে দাঁড়াল, মিজুগুশি নানামির লাশ খুঁজতে লাগল।
“খুনি আর মিজুগুশি নানামি এদিক দিয়ে একসাথে হেঁটে গিয়েছিল,” পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে ও বলল।
আমরা মঠ পেরিয়ে পিছনের বনে গিয়ে ঢুকলাম। কোনদিকে যেতে হবে, কতদুর যেতে হবে কিছুই আমাদের জানা ছিল না তাই আমরা এদিক ওদিক খুঁজতে লাগলাম।
“হয়তো ওইদিকে হবে,” মোরিনো আমার দিক থেকে অন্যদিকে যেতে যেতে বলল।
কয়েক মিনিট পর শুনতে পেলাম ও আমার নাম ধরে ডাকছে। আমি ওর গলা লক্ষ্য করে এগিয়ে গিয়ে দেখি ও একটা ক্লিফের গোরায় দাঁড়িয়ে। আমার দিকে পেছন ফিরে আছে। শরীর শক্ত হয়ে আছে, দু হাত পাশে ঝুলছে। আমি ওর পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম। ও যেদিকে তাকিয়ে ছিল সেদিকে তাকালাম : ঐ যে মিজুগুশি নানামি।
বন আর ক্লিফের মাঝখানে, একটা বড় গাছের ছায়ায়, গ্রীষ্মের হালকা আলোতে একটা নগ্ন মেয়ে বসে আছে। মিজুশি নানামি মাটিতে বসে ছিল, ওর পিঠ গাছের উপর হেলান দেয়া, হাত পা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে, ঘাড়ের উপরে কিছু নেই। পেট কেটে গর্ত করা হয়েছে। মাথাটা সেই গর্তে ঢুকানো।