আমাদের প্রথম আলাপ হওয়ার কিছুক্ষণ পরে আমার মনে হয়েছিল ও হয়তো কোন ধরনের পুতুল-টুতুল হবে। ওর প্রতিক্রিয়া মানুষের চেয়ে কোন জড়বস্তুর সাথেই বেশি মিলে।
***
অক্টোবরের এক বুধবার। গাছের পাতাগুলো তখন সবুজ থেকে লাল হতে শুরু করেছে। মোরিনো মাথা নিচু করে এসে ক্লাসে ঢুকল। ক্লাসের উপস্থিত সবাই সাথে সাথে থেমে গেল। ওর লম্বা ঘন কালো চুলগুলো মুখ ঢেকে রেখেছিল। ওর ধীর গতির পা টেনে টেনে হাঁটা দেখতে কেমন জানি ভূতুড়ে লাগত। বেশিরভাগ শিক্ষার্থীরাই হয়তো ভাবত ওকে দেখতে ভুতের মত লাগে-কিন্তু ওর আশেপাশের পরিবেশ অন্য রকম, আরো বিপজ্জনক কিছু মনে হয়। যেন কোন বন্য প্রাণী।
ওর চারপাশের দেয়াল যেন স্বচ্ছ কোন গোলক যেটায় সুচালো পেরেক লাগানো আছে। ওকে দেখে মনে হচ্ছিল কেউ ওর কাছাকাছি এলে ও তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে। বরাবরের মতই ও নির্বাক ছিল, আর কেউই ওর সাথে যেচে পড়ে কথাও বলতে গেল না। কিন্তু তারপরেও ওর মুড সেদিন অন্যরকম লাগছিল। ওর কাছাকাছি যারা বসে ছিল তাদের মুখেও টেনশনের ছায়া দেখা যাচ্ছিল।
আমার অতটা কৌতূহল হচ্ছিল না। আমি ধরে নিয়েছিলাম কোন কারনে হয়তো ওর মেজাজ খারাপ। সেদিন আর পরে আমাদের কথা বলার সুযোগ হয়নি। সুতরাং কারনটাও আর জানা সম্ভব হয়নি (আমি যখন আমার ক্লাসমেটদের সাথে কথা বলি তখন মোরিনো আমার সাথে কথা বলে না। কারণটা জানা গেল পরেরদিন, স্কুল ছুটির পর।
হোমরুম শেষ হওয়ার পর সবাই ক্লাস থেকে বেরিয়ে গেল। ক্লাস এত নিরব হয়ে গেল যে বিশ্বাসই হচ্ছিল না একটু আগে এখানে কি রকম হাউকাউ হচ্ছিল। শুধু খালি ডেস্কগুলো, মোরিনো আর আমি রুমে থেকে গিয়েছিলাম।
জানালা দিয়ে আরামদায়ক ঠান্ডা বাতাস এসে ঢুকল। আমাদের পাশের ক্লাস তখনো ছুটি হয়নি। হলের অন্য মাথা থেকে টিচারের গলার আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছিল।
মোরিনো ওর সিটে বসা, হাতগুলো পাশে উদ্দেশ্যহীনভাবে ঝুলছে। ওকে দেখে মনে হচ্ছে বেশ ক্লান্ত।
“আমার ঘুম হচ্ছে না,” হাই তুলতে তুলতে বলল সে। ওর চোখের নিচে কালি জমেছিল। চোখগুলো আধবোজা হয়ে ছিল, এমনভাবে তাকিয়ে ছিল যেন দূরে কিছু একটা দেখছে।
আমি আমার সিটে বসে ছিলাম, বাসায় যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছিলাম। ওর সিট রুমের একদম অন্য কোণায়। রুমে আর কেউ ছিল না বলে ওর কথা ভালো মতই শুনতে পেলাম, কাছাকাছি যেতে হলো না।
“এ কারনেই কি তুমি কালকে অদ্ভুত আচরণ করছিলে?”
“এরকম হয় মাঝে মাঝে। যত চেষ্টা করি না কেন ঘুম আসে না। ইনসমনিয়া হয়তো।”
সে উঠে দাঁড়াল। মনে হচ্ছিল ঘুমে পড়ে যাচ্ছে, টলতে টলতে ব্ল্যাক বোর্ডের দিকে এগুলো।
রুমের সামনে একটা আউটলেট ছিল। একটা কর্ড দিয়ে সেটার সাথে ইরেজার ক্লিনার লাগানো। মোরিনো সেই কর্ডটা নিয়ে গলায় পেঁচিয়ে দাঁড়িয়ে থাকল।
“নাহ ঠিক লাগছে না,” সে মাথা নাড়তে নাড়তে কর্ডটা খুলে রাখল। “আমি যখন ঘুমাতে পারি না তখন গলায় কিছু একটা পেঁচিয়ে চোখ বন্ধ করি। কল্পনা করি গলায় ফাঁস দিয়ে আমাকে মেরে ফেলা হচ্ছে। তখন ঘুম আসে-গভীর পানিতে ডুবে যাওয়ার মত অনুভূতি হয়।”
আমার বিরক্ত লাগছিল। ও কি অনিদ্রার চোটে পাগল হয়ে গেল নাকি? “এতে যদি উপকার হয় তাহলে করছো না কেন?”
“যেকোন দড়ি পেঁচালেই হবে না।”
মোরিনো একটা বিশেষ ধরনের দড়ি খুঁজছিল, ইরেজার ক্লিনারের সাথের কর্ডটা দিয়ে সে কাজ হবে না।
“আমি যেটা ব্যবহার করতাম সেটা হারিয়ে ফেলেছি। নতুন একটা খুঁজছি কিন্তু..” সে হাই তুলল। “আমি জানি না আসলে কি খুঁজছি। খুঁজে পেলে ইনসমনিয়াকে গুডবাই দিতাম।”
“আগে কি ব্যবহার করতে?”
“জানি না। এমনি খুঁজে পেয়েছিলাম। ওটা ছাড়া ঘুমাতে পারার পর কোথায় রেখেছিলাম ভুলে গিয়েছি।”
চোখ বন্ধ করে গলায় হাত বুলালো। “আমার শুধু মনে আছে জিনিসটা কেমন লাগত..” ঝট করে চোখ খুলল যেন হঠাৎ কোন আইডিয়া এসেছে মাথায়। “চল দড়ি কিনতে যাই। তুমিও কিছু দড়ি কিংবা কর্ড কিনে রাখতে পার, কোন একদিন কাজে লাগতে পারে। কোনদিন আত্মহত্যা করতে চাইলে ব্যবহার করতে পারবে।”
অন্য ক্লাসটার ছুটি হলো। চেয়ার সরানোর শব্দ কানে আসছিল আমার।
***
স্কুল থেকে বেরিয়ে শহরের শেষ মাথার এক জেনারেল স্টোরের দিকে পা বাড়ালাম আমরা। জায়গাটা বেশ দূরে। কিন্তু বড় রাস্তায় অনেক বাস থাকায় সেখানে যেতে আমাদের খুব একটা সময় লাগল না। বাসটা অর্ধেকের মত খালিই ছিল। মোরিনো সিটে বসল আর আমি দাঁড়িয়ে স্ট্র্যাপে ঝুলতে ঝুলতে ওর দিকে তাকিয়ে ছিলাম। ও মাথা নিচু করে ঘুমানোর চেষ্টা করছিল। কিন্তু বাসের দুলুনিতে ঘুমানো সম্ভব ছিল না। এক ফোঁটা ঘুমও আসার আগে আমরা জায়গা মত পৌঁছে গেলাম।
বিশাল দোকানটা কন্সট্রাকশনের কাঠ আর ধাতব উপাদান, বিভিন্ন ধরনের যন্ত্রপাতি দিয়ে ভর্তি ছিল। আমরা সারি সারি সেলফের ভেতরের পথগুলো দিয়ে ঘোরাফেরা করলাম, দড়ির মত কিছু দেখলেই থেমে পরীক্ষা করলাম। টিভি কিংবা ভিডিও প্লেয়ার কানেক্ট করার এভি কেবল, কাপড় ঝুলানোর দড়ি, ঘুরি উড়ানোর সুতা…সব কিছু ওখানে ছিল।
মোরিনো সেগুলো একটা একটা করে তুলে প্রথমে আঙুল বুলিয়ে কিছু একটা অনুভব করার চেষ্টা করল-যেন সাবধানতার সাথে কোন পোশাক পরীক্ষা করে দেখছে।