কাজটা খারাপ করেছি বলে আমার মনে হয় না। ন্যায়-অন্যায় নিয়ে আমি মাথা ঘামাই না। হয়তো আমার মনে হয়েছিল ছুরিটা তার ভবিষ্যৎ দেখতে পেয়েছে। ছুরিটা চেয়েছে এই ঘটনার মধ্যে অংশগ্রহণ করতে।
***
কয়েক ঘন্টা পর মেয়েটাকে খুঁজে পাওয়া গিয়েছিল। উড্রান্তের মত ঘোরাঘুরি করছিল। তাকে নিরাপত্তা কাস্টডিতে নেয়া হয়। ওর মুখে আর কাপড়ে রক্ত লেগে ছিল।
মোরিনোর থেকে পাওয়া মেসেজে আমি এই তথ্য জানতে পারলাম। আমার রুম অন্ধকার আর নিস্তব্ধ হয়ে ছিল। আমি কখনোই মিউজিক শুনি না। নিচের তলা থেকে আসা শব্দ থেকে বুঝতে পারছিলাম সাকুরা কুকুরটার সাথে খেলছে।
আমি চোখ বন্ধ করে কল্পনা করতে লাগলাম গ্রীষ্মের কোন গরমের দিনে মেয়েটা আর কুকুরটা ব্রিজের নিচে খেলছে। আর সবুজ লম্বা ঘাসগুলো ওদেরকে চারদিক থেকে ঘিরে রেখেছে।
৪. স্মৃতি/ যমজ
স্মৃতি/ যমজ
১
আমার একজন ক্লাসমেট আছে যার বংশের পদবি মোরিনো। আমাদের মধ্যে মাঝে মাঝে কথা হয়। ওর আসল নাম ইয়োরু। পুরো নাম-মোরিনো ইয়োরু, যার অর্থ “রাতের অরণ্য।” ওর চোখ চুল সব ঘন কালো। আমাদের স্কুলের ইউনিফর্মও কালো, আর মোরিনো সবসময় কালো জুতা পড়ত। কালোর বাইরে একমাত্র অন্য রং বলতে ওর পোষাকে যেটা ছিল সেটা হল ইউনিফর্মের লাল স্কার্ফ।
মোরিনোর কালো পোশাক-পরিচ্ছদের সাথে ইয়োৰু নামটা ভালো যায়। কালোর প্রতি ওর ভালবাসা এত বেশি যে আমার মাঝে মাঝে মনে হয় যদি রাতের আঁধারকে মানুষের রূপ দেয়া হয় তাহলে সেটা দেখতে ওর মতই লাগবে।
এত সব কালোর বিপরীতে ওর ত্বকের রং ছিল চাঁদের মত ফ্যাকাসে সাদা। মনে হত জীবনে কোনদিন সূর্যের মুখ দেখেনি। ওকে রক্ত মাংসের মানুষও মনে হত না, যেন পোরসেলিন দিয়ে বানানো। ওর বাম চোখের নিচে ছোট্ট একটা তিল ছিল, যে কারনে ওকে আরো রহস্যময়ি লাগত। মনে হত যেন একজন ভবিষ্যৎ বক্তা।
এরকম একটা মেয়েকে আমি একবার একটা সিনেমাতে দেখেছিলাম। সিনেমার শুরুতে এক দম্পতিকে পানিতে ডুবে মরতে দেখিয়েছিল। পুরো সিনেমার বাকিটা ছিল মৃত্যুর পর তাদের জীবন নিয়ে। মূল চরিত্রগুলো ভূত ছিল, সাধারণ মানুষরা তাদের চোখে দেখতে পারত না। কিন্তু একজন মেয়েকে পাওয়া গেল যে তাদের দেখতে পেত। সেই মেয়েটাই সিনেমাটার নায়িকা, নাম ছিল নিডিয়া।
“আমাকে আসলে অর্ধমৃত বলা যায়,” নিডিয়া ব্যাখ্যা করেছিল কেন সে ভূত দেখতে পায়। “আমার হৃদয় আঁধারে পরিপূর্ণ।”
নিডিয়ারও সব পোশাক ছিল কালো আর তুকের রং ছিল ফ্যাকাসে। সে ঘরের বাইরে বের হত না। বাইরে যাওয়ার বদলে বাসায় বসে বই পড়তে পছন্দ করত। আর ওকে দেখে মনে হত পুষ্টিহীনতায় ভুগছে।
লোকজন ওর মত মানুষদেরকে “গ” বলে ডাকত। গথ বলতে আসলে একটা সংস্কৃতি, একটা ফ্যাশন, আর একটা স্টাইলকে বুঝায়। অনলাইনে ‘গথ’ কিংবা ‘গসু সার্চ দিলে হাজার হাজার পেইজ পাওয়া যাবে। ‘গথিক’-এর সংক্ষিপ্ত রূপ হলো ‘গথ’, কিন্তু এই নামের ইউরোপিয়ান স্থাপত্য স্টাইলের সাথে এর কোন সম্পর্ক নেই বললেই চলে। বরং ভিক্টোরিয়ান লন্ডনের জনপ্রিয় গথিক হরর উপন্যাসের সাথেই এর মূল সম্পর্ক। যেমন ‘ফ্রাঙ্কেন্সটাইন’ কিংবা ‘ড্রাকুলা।’
মোরিনোকে চোখ বন্ধ করে গথ বলা চলে। অত্যাচারের প্রক্রিয়া কিংবা হত্যা করার যন্ত্রপাতির প্রতি ওর বিশেষ আগ্রহ রয়েছে। মানুষের অন্ধকার দিক নিয়েও ওর আগ্রহ প্রচুর যা গথদের মধ্যে কমন।
মোরিনো প্রায় কখনোই কারো সাথে কথা বলে না। আমাদের স্বাস্থ্যবান, হাউকাউ করা ক্লাসমেটদের সাথে ওর বিন্দুমাত্র কোন মিল নেই। কোন ক্লাসমেট যদি হেসে ওর সাথে কথা বলে তাহলে মোরিনো সেফ ওর দিকে তাকিয়ে থাকবে, ওর শূন্য অভিব্যক্তি অপরিবর্তিত রেখে শুধু বলবে “ওহ আচ্ছা।” তারপরেও কেউ যদি ওর কাছ থেকে কোন উত্তরের জন্য অপেক্ষা করে তাহলে তাকে ব্যর্থ মনে ফেরত যেতে হবে কারণ মোরিনো আর কিছুই বলবে না।
বশির ভাগ মানুষই ওর সাথে কথা বলতে এলে এরকম উপেক্ষার শিকার হয়। ক্লাসের মেয়েরা কথা বলার অনেক চেষ্টা করে শেষে হাল ছেড়ে দিয়েছে।
ওর এই হাবভাব ওর চারপাশে একটা দেয়াল তৈরি করে, সবাইকে দূরে সরিয়ে রাখে। সবাই যখন গল্প করছে কিংবা হাসাহাসি করছে, তখন দেখা যায় মোরিনো কোথাও চুপচাপ একাকি বসে আছে। তখন ওকে দেখে মনে হয় যেন অন্য কোন জগতে চলে গিয়েছে, কিংবা ও যেখানে বসে আছে সেখানে কোন কিছুর ছায়া পড়েছে।
কিন্তু মোরিনো আসলে ইচ্ছা করে কাউকে উপেক্ষা করত না। ওর সাথে কিছুদিন কথা বলার পর আমি এ ব্যাপারে নিশ্চিত হয়েছি। ও আসলে হাসিখুশিভাবে কথা বলতে পারত না, মানুষটাই ওরকম ছিল। অন্যদের সাথে ওর কোন সমস্যা নেই। ও সবার থেকেই সমান দূরত্ব বজায় রেখে চলত।
ভালোভাবে ওকে পর্যবেক্ষণ করার পর আমি সমস্যাটা বুঝতে পারলাম। মোরিনো যখন কারো সাথে কথা বলত তখন সে আসলে বুঝতে পারত না কি প্রতিক্রিয়া দেখাতে হবে, উত্তর দেয়ার মত কিছু সে খুঁজে পেত না। কিন্তু এর পুরোটাই স্রেফ আমার অনুমান ছিল, সত্যি সত্যি সে কী ভাবত তা আসলে আমি জানতাম না। বেশিরভাগ সময়ে তার কোন অভিব্যক্তি দেখা যেত না। যে কারনে ও কী ভাবছে তা কল্পনা করা দুরূহ ছিল।