কাছে গিয়ে কুকুরটার মাথায় হাত বোলালাম। কুকুরটাকে ভীত মনে হলো না, আমাকে স্পর্শ করতে দিল।
ওর কলারের সাথে একটা কাগজ গোঁজা ছিল। সেটা বের করে নিলাম।
“যে আমাকে ছুরিটা দিয়েছে তার জন্য,” উপরে লেখা।
মেয়েটা আমাকে একটা চিঠি লিখেছে। সে অনুমান করেছে আমি তাকে খুঁজতে এখানে আসব।
চিঠির কাগজটা একটা নোটবুক থেকে ছেঁড়া, আর পেন্সিল দিয়ে লেখা। সম্ভবত সিঁড়িতে বসে লেখা, ভাঙাচোরা লেখা দেখে তাই মনে হলো।
যদিও লেখা উলোটপালট ছিল কিন্তু তাও আমি মোটামুটি এর অর্থ বুঝতে পারলাম। সে লিখেছে কেন সে কুকুরগুলোকে চুরি করত আর সেগুলোকে ব্রিজের নিচে এনে কি করত। সে লোকটার হিংস্রতার বর্ণনা দিয়েছে আর আমাকে ধন্যবাদ দিয়েছে ছুরিটা তাকে দেয়ার জন্য। একদম শিশুসুলভ লেখা, কিন্তু আমি বুঝতে পারছিলাম সে তার মত করে সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছে।
শেষে লিখেছে কুকুরটাকে আমি যেন গ্রহণ করি। এটা লিখতে নিশ্চয়ই তার অনেক সময় লেগেছে। অনেকবার লিখে মোছা হয়েছে আবার লেখা হয়েছে। নিশ্চয়ই অনেক কষ্ট করে লিখেছে। আমার ধারণা ও বুঝতে পেরেছিল কুকুরটাকে ওর সাথে পাওয়া গেলে হয়তো সেটাকে মেরে ফেলা হতে পারে।
আমি চিঠিটা পকেটে রেখে ধৈর্য ধরে বসে থাকা কুকুরটার দিকে তাকালাম। কুকুরটার গলায় শুধু কলার পরানো ছিল, কোন ফিতা ছিল না। কিভাবে এটাকে নিয়ে যাব ভাবছিলাম। নাকি এখানেই ফেলে যাব?
গতকাল দেখেছিলাম মেয়েটা ইশারা করতেই কুকুরটা পিছু পিছু গিয়েছিল, আমিও সেরকম চেষ্টা করলাম। কুকুরটা সুন্দর মত আমার পিছু পিছু আসতে থাকল।
বাড়ি ফেরা পর্যন্ত পুরো রাস্তা কুকুরটা আমার পেছন পেছন হেঁটে এল। আমি ভেবেছিলাম যদি অন্যদিকে যায় তাহলে আর ডাকব না। কিন্তু সে তা করেনি।
বাবা-মা বাসায় ছিল না, কিন্তু সাকুরা টিভির সামনে বসে ওর হোমওয়ার্ক করছিল। কুকুর দেখে ও চমকে গেল। আমি ওকে বললাম এটা এখন থেকে আমাদের কুকুর। সাকুরা চমকে গেলেও তাড়াতাড়ি মানিয়ে নিল। লাশ দেখার চেয়ে কুকুর অনেক ভাল। ও চিন্তা করতে শুরু করে দিল কুকুরটার নাম কি রাখবে। আমি ওকে সেখানেই থামিয়ে দিলাম। ব্রিজের নিচে আমি কুকুরটার প্রাক্তন মনিবকে ওর নাম ধরে ডাকতে শুনেছিলাম। চিঠিতেও নামটা লেখা ছিল। সাকুরাকে বললাম, কুকুরটার নাম ইয়ুকা।
সকালে জানালা দিয়ে মেয়েটার ঘরে কি দেখেছিলাম মনে পড়ল। মেয়েটা তখন লোকটার গলায় কামড় বসাচ্ছিল। প্রথমে আমি বুঝতে পারিনি কি হচ্ছিল-চিঠিটা পড়ার পর বুঝতে পেরেছি। মেয়েটা অন্য কুকুরগুলোর সাথে ব্রিজের নিচে লড়াই করে নিজেকে প্রস্তুত করছিল ঐ লোকটাকে খুন করার জন্য।
ইয়ুকাকে সাকুরার হাতে ছেড়ে দিয়ে আমি সোফায় বসে চিঠিটা বের করে আবার পড়লাম। পেন্সিলে লেখা চিঠিটা পড়ে বোঝা যাচ্ছিল অন্য অনেক বাচ্চার মত সেও কঠিন সময় পার করছিল। বুঝতে পারছিলাম ও ওর কুকুরের উপাসনা করত।
আগের রাতের কথা মনে পড়ল আমার। লড়াইয়ের আগে মেয়েটা রিট্রিভারটার দিকে তাকাত। জামাকাপড় যাতে নোংরা না হয় সেজন্য সেগুলো আগে খুলে নিত।
মেয়েটা কুকুরের সাথে এমনভাবে কথা বলছিল যেন ঐশী বানী শুনতে পারছিল। চিঠিতেও সে স্পষ্ট লিখেছে যে সে কুকুরটার কথা বুঝতে পারত।
“এই কুকুরটা আমাদের কী করে হলো?” সাকুরা জানতে চাইল।
আমি বললাম কুকুরটা আমার এক বন্ধুর ছিল। কিন্তু ওর সৎ বাবা কুকুর ঘণা করে আর কুকুরটার উপর অত্যাচার করত। তাই বন্ধু আমাকে বলেছে এটার দায়িত্ব নিতে। কথাটা সত্যির থেকে খুব একটা দূরে নয়। চিঠিতে লেখা ছিল মেয়েটার মায়ের বয়ফ্রেন্ড কিভাবে কুকুরটার উপর অত্যাচার করত। যে কারনে সে লোকটাকে খুন করার প্ল্যান করতে বাধ্য হয়।
“কে এরকম একটা সুন্দর কুকুরের উপর অত্যাচার করতে পারে?” সাকুরা অবাক হয়ে প্রশ্ন করল। ইয়কা মাথা ঘুরিয়ে ওর গভীর কালো চোখগুলো দিয়ে সাকুরার দিকে তাকাল। আমি জানি না মেয়েটা যা বলেছে কুকুরটা সম্পর্কে, সেটা আসলেই সত্যি কিনা, কুকুরটা আসলেই এত কিছু জানত কিনা। মেয়েটা হয়তো স্রেফ কুকুরটার চোখে নিজের প্রতিচ্ছবি দেখত।
আমার সেল ফোন বাজল। মোরিনো ফোন করেছে। আমি ইয়ুকা আর সাকুরাকে রেখে উপরের তলায় গেলাম। মোরিনো আমাকে আমাদের পাশের এলাকায় হওয়া একটা খুনের খবর দিল।
“আমরা সেদিন যে রাস্তা দিয়ে গেলাম না? ওদিকেই হয়েছে খুনটা! মহিলাটা তার বাড়ির দরজার সামনে লোকটাকে পড়ে থাকতে পেয়েছে।”
“আচ্ছা,” আমি বললাম। তারপর লোকটার গলায় কিভাবে দাঁতের দাগ এল, বেডরুম থেকে দরজা পর্যন্ত রক্তের দাগ, আর কিভাবে আরেকজনের এগিয়ে দেয়া ছুরিটা দিয়ে লোকটা খুন হলো সব ওকে ব্যাখ্যা করলাম।
“তুমি এত কিছু জানো কী করে?”
“আমরা সেদিন যে পিচ্চি মেয়েটাকে হেঁটে যেতে দেখেছিলাম সেই আসলে খুনি,” বলে ফোন রেখে দিলাম।
অপরাধিদের কর্মকাণ্ড দেখতে আমার ভালো লাগে। কিন্তু আমার একটা শর্ত আছে। আমি সবসময়ই একজন তৃতীয় পক্ষ, কখনো ঘটনার সাথে নিজেকে জড়াই না। এইবার আমি সেই শর্ত ভঙ্গ করেছি। মেয়েটাকে আর কুকুরটাকে দরজার দিকে দৌড়ে যেতে দেখলাম, পিছু পিছু লোকটাও ছুটে গেল। আমি নিজে কিছু বোঝার আগেই কখন যেন মেয়েটার দিকে ছুরিটা ছুঁড়ে দিলাম।