যদি আমরা আগের মত আবার খেলতে যেতে পারতাম…
লোকটার ছায়া আমার ছায়ার কাছে পৌঁছে গেল। আমি মাথা নিচু করেই থাকলাম, নড়ছিলাম না। লোকটার দু হাত আমার মুখের দুপাশে পৌঁছে গেল। চোখের কোনা দিয়ে আমি রক্তাক্ত লাল হাতগুলো দেখতে পাচ্ছিলাম। তার ছায়া আমাকে এমনভাবে ঢেকে ফেলল যেমনভাবে সূর্য অস্ত গেলে চারদিক আঁধারে ঢেকে যায়।
ইয়ুকা…
আমার চোখ থেকে অশ্রু গড়িয়ে পড়ল।
সেই মুহূর্তে আমার পেছনে কিছু একটা শুনতে পেলাম। আমার পেছনে দরজার বাইরে জুতার শব্দ। একটা কাঁচকোঁচ শব্দ হলো তারপর আমার পায়ের কাছে ধাতব কিছু একটা এসে পড়ল।
মাথা নিচু করে ছিলাম বলে জিনিসটাকে ঝনঝন করে পড়তে দেখলাম। লোকটার ছায়া পড়ার পরও জিনিসটা চকচক করছিল।
ঝনঝন শব্দের কারনে আমার দুপাশে হাত দুটো থেমে গেল। এক মুহূর্তের জন্য সব শব্দ থেমে গেল। যেন সময়ই থেমে গিয়েছিল।
আবার জুতার শব্দ শোনা গেল। কিন্তু সেগুলো এবার দূরে সরে যাচ্ছিল। খবরের কাগজ দেয়ার জন্য দরজায় একটা সুট লাগানো ছিল। ক্যাঁচকোঁচ শব্দটা ওটার থেকে এসেছে।
আমি জানতাম আমাদের যে পিছু নিয়েছিল এটা সেই লোকটা। যার ছায়া আমি একটু আগে জানালায় দেখেছিলাম।
ছায়ার উপস্থিতি আগে থেকে আমার জানা থাকার কারনে লোকটা আবার তৈরি হওয়ার আগেই আমি সরে যেতে পারলাম। এক মুহূর্তের সুযোগ আমাদের ভাগ্য তৈরি করে দিল…
***
মেয়েটা আর তার কুকুর দরজা দিয়ে ছুটে বেরিয়ে দৌড়ে পালিয়ে গেল। আমি অন্যদিকে এক কোনায় লুকিয়ে ছিলাম। ওরা আমাকে খেয়াল করেনি।
ওরা দৃষ্টির আড়াল হওয়ার পর আমি বাড়িতে গিয়ে ঢুকলাম। সামনের দরজা লক করা ছিল না। ভেতরে লোকটার মৃতদেহ চিত হয়ে পড়ে আছে। পরিস্কার দেখতে পাচ্ছিলাম ছুরিটার হাতল পর্যন্ত সরাসরি লোকটার হৃদপিণ্ডে ঢুকে আছে। রক্তের একটা পুকুর সৃষ্ট হয়েছে লোকটার চারপাশে। হল থেকে রক্তের একটা ধারাও চলে এসেছে দরজা পর্যন্ত। ভালো করে সবকিছু লক্ষ্য করলাম। খেয়াল রাখলাম যেন কোন কিছু স্পর্শ না করি। লোকটা কে তা আমার জানা ছিল না। অনুমান করছি মেয়েটার বাবা হবে। ওর কোন মা নেই? আমি একটা ছবি তুলে নিয়ে সেখান থেকে চলে আসলাম। আসার সময় ভাবছিলাম ছুরিটা নিয়ে আসব কিনা, পড়ে ভাবলাম থাক-দেখে মনে হচ্ছিল ছুরিটা তার প্রকৃত জায়গা খুঁজে পেয়েছে।
চলে আসার আগে জামার হাতা দিয়ে দরজার নব ভালো করে মুছে এলাম। আমার হাতের ছাপ কোথাও পাওয়া যাক তা অবশ্যই চাই না।
বাসায় ফিরে দেখি সাকুরা টিভি দেখতে দেখতে হোমওয়ার্ক করছে।
“কোথায় গিয়েছিলে?” সে জানতে চাইল।
ওকে বললাম শপিং মলের কথা। তারপর নাস্তা করলাম।
নাস্তার পর আবার মেয়েটার বাসার দিকে গেলাম। দূর থেকেই হৈচৈ কানে আসছিল। কাছাকাছি যেতেই দেখতে পেলাম লোকজনের ভিড়। পুলিশের গাড়ি দেখা যাচ্ছে। নিশ্চয়ই কেউ ফোন করে পুলিশে খবর দিয়েছে।
পেট্রোল কারের লাল আলো বাড়ির দেয়ালে ঘুরে ঘুরে পড়ছিল। রাস্তায় দাঁড়ানো লোকগুলো ফিসফিস করছিল। তারা সম্ভবত প্রতিবেশি হবে-এপ্রন পরা গৃহিণী আর পাজামা পরা মধ্যবয়স্ক লোকজন সব। আমি ওদের পেছনে দাঁড়িয়ে বাড়িটার দিকে তাকালাম, আর ওদের কথা শোনার চেষ্টা করলাম।
যা শুনলাম তাতে মনে হল যে মহিলা এই বাড়িতে থাকে, সে বাসায় ফিরে দেখতে পায় লোকটা বুকে ছুরি নিয়ে মূল দরজার কাছে পড়ে আছে।
তার মানে লোকটা মেয়েটার বাবা ছিল না।
আমি আস্তে ধীরে এপ্রন পরা এক মহিলার সাথে খাতির জমিয়ে ফেললাম। বাড়িটার বাসিন্দাদের সম্পর্কে তার কাছে জানতে চাইলাম। সে যদিও আমাকে চিনত না, কিন্তু খুশি মনে আমার প্রশ্নের উত্তর দিল। উত্তেজনার চোটে কোন সন্দেহ করল না।
বাড়িতে এক মহিলা, তার মেয়ে আর একটা কুকুর থাকত। ডিভোর্সের কারনে মেয়েটার বাবা ছিল না। মেয়েটা স্কুলে যেতে চাইত না। তার বদলে সে সারাদিন কুকুরটাকে নিয়ে ঘরেই থাকত।
এপ্রন পরা মহিলার দেয়া তথ্য অনুযায়ি মেয়েটা আর কুকুরটা নিখোঁজ। কেউ জানে না তারা এখন কোথায়।
আমি ভিড় থেকে সরে এসে হাঁটতে লাগলাম। এক ব্লক দূরে এসে দেখলাম কিছু বাচ্চাকাচ্চা সাইকেল চালিয়ে ক্রাইম সিন দেখতে যাচ্ছে, যেন কোন উৎসব হচ্ছে সেখানে।
***
এক সারি কংক্রিটের সিঁড়ি ব্রিজ থেকে নদীর তীর পর্যন্ত নেমে গিয়েছে, যে জায়গাটা সবুজ ঘাসের সমুদ্রে ঢাকা।
দিনটা সুন্দর ছিল। সিঁড়ির উপর পরিস্কারভাবে আমার ছায়া পড়ছিল। সূর্যের আলোয় সবুজ ঘাসগুলো ঝকমকিয়ে উঠছে, আর বাতাসে সেগুলোর উপর দিয়ে ঢেউ বয়ে যাচ্ছে যেন।
সিঁড়ির শেষে পৌঁছে আমি দেখলাম চারদিকে শুধু ঘাস আর ঘাস, লম্বায় আমার সমান। উপরে তাকালে বিশাল ব্রিজটা দেখা যায়, সাথে মেঘহীন আকাশ।
ঘাস ঠেলে আমি সামনের খোলা জায়গাটায় গেলাম। একটা গোল্ডেন রিট্রিভার চুপচাপ খোলা জায়গাটার মাঝখানে বসে আছে। মেয়েটার কোন চিহ্ন নেই।
কুকুরটা কোথাও বেঁধে রাখা ছিল না। তারপরেও ঘাসের দেয়াল দিয়ে ঘিরে থাকা জায়গাটায় সে মূর্তির মত বসে ছিল। যেন সে জানত কেউ একজন তার খোঁজে কোন এক সময় সেখানে আসবে। কী সুন্দর একটা কুকুর, আমি ভাবলাম। চোখগুলোতে বুদ্ধির ছটা।
আমি ভেবেছিলাম কুকুর আর মেয়েটা, দু-জনকেই সেখানে পাব। কিন্তু আমার অনুমান অর্ধেক সত্যি হলো।