রক্তের লাল ফোঁটা টপ টপ করে লোকটার পায়ের কাছে ঝরে পড়ছে। আমি লোকটার পায়ের কাছে থেকে তাঁর মুখের দিকে তাকালাম। সে তখন গলায় হাত দিয়ে আছে, হতভম্ব। গলার একটা অংশ ছিঁড়ে আলাদা হয়ে ঝুলে আছে। সেদিক দিয়ে রক্ত ছিটকে বের হচ্ছে। লোকটা হাত দিয়ে চেপে থাকলেও আঙুলের ফাঁক দিয়ে রক্ত বের হয়ে আসছে।
আমি উঠে দাঁড়িয়ে মুখের ভেতর যেই জিনিসটা ছিল সেটা থু করে ফেললাম ফুটোনের উপর। এক দলা মাংস, যেটা লোকটার গলা থেকে ছিঁড়ে নিয়েছিলাম।
সে যখন মাংসের টুকরোটা দেখল, তার চোখ প্রশস্ত হয়ে গেল, হাঁটু গেড়ে বসে হাত দিয়ে মাংসের টুকটা তুলে চেপে গলায় লাগানোর চেষ্টা করল। কিন্তু রক্তের সোতে সেটা খুলে আসছিল। তার হাত কাঁপছিল, মাংসের টুকরাটা হাত গলে নিচে পড়ে গেল। লোকটা আবার সেটা ভোলার চেষ্টা করল না। বরং মাথা ঘুরিয়ে আমার দিকে তাকাল। তার মুখ ভয়াবহ দেখাচ্ছিল, মনে হচ্ছিল যে কোন সময় কেঁদে ফেলবে। হা করে সে হুংকার ছাড়ল। হুংকারের সাথে গলা থেকে অদ্ভুত একটা হিসহিস শব্দ হলো। তারপরেও হুংকারটা যথেষ্ট জোরাল ছিল, ঘরের দেয়ালে বাড়ি খেয়ে প্রতিধ্বনি তুলল।
তারপর সে আমাকে আক্রমণ করল। লোকটা অত্যন্ত শক্তিশালী। পেটে লাথি খেয়ে আমি প্রায় অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছিলাম।
ইয়ুকা দরজার কাছে দাঁড়িয়ে চিৎকার করল। ও সেখানে জমে গিয়েছে, কী করবে বুঝতে পারছে না।
“পালাও!” আমি চিৎকার করলাম, কিন্তু সে আমাকে ফেলে কোথাও গেল না। দাঁড়িয়েই থাকল।
লোকটা হাত দিয়ে তার গলা ধরে আমাকে রক্তাক্ত তাতামির উপর লাখি মারতে লাগল। সেই সাথে অশ্রাব্য গালিগালাজ। কথা বলার সময় তার মুখ থেকে থুথু আর রক্ত ছিটকে বেরিয়ে আমার গায়ে পড়ছিল।
আমি লোকটার হাত কামড়ে ধরলাম। সে সাথে সাথে হাত টেনে নিল। ইক সময়ই আমাদের জন্য যথেষ্ট ছিল। আমি আর ইয়কা এক সাথে দৌড় লাগালাম।
নোটার প্রচুর রক্তক্ষরণ হচ্ছিল কিন্তু এই রক্তক্ষরণে মরবে মনে হচ্ছে না। কোন কুকুর হলে হয়তো এতক্ষণে হার মেনে নিত কিন্তু মানুষের কথা আলাদা। লোকটা ক্রোধে অন্ধ হয়ে গিয়েছিল, পাল্টা আক্রমন করেছিল।
আমি আর ইয়ুকা যখন দৌড়ে হলওয়ে পার হচ্ছিলাম তখন পেছনে বজ্রপাতের মত জোরালো শব্দ হলো। লোকটা স্লাইডিং ডোর দিয়ে এমনভাবে উড়ে বেরিয়ে এসেছে যে একটুর জন্য দরজাটা ভেঙে পড়েনি।
আমি খুব ভয় পেয়েছিলাম। কোনভাবেই একে খুন করা আমার ক্ষমতার মধ্যে নেই। সে আমার চেয়ে অনেক অনেক গুণ শক্তিশালী। আমি হয়তো তাকে বারবার কামড় দিতে পারতাম কিন্তু সে সেফ দাঁড়িয়ে আমাকে লাখি মারলেই হতো। আর সে যদি আমাকে মেরে ফেলতে পারে তাহলে এরপর ইয়কাকে মারবে। আমি বুঝতে পারছিলাম না কি করব।
আমরা মূল দরজার দিকে ছুটতে লাগলাম। লোকটার পায়ের শব্দ কানে আসছিল, সে আমাদের পেছন পেছন দৌড়ে আসছে। শব্দটা ক্রমেই নিকটতর হচ্ছে।
আম্মুর ঘর থেকে বেরিয়ে একটা বাঁক নিলেই সোজা হলওয়ে। মূল দরজা একদম কাছে হলেও আমাদের মনে হচ্ছিল অনন্তকাল লাগছে।
দরজার প্রায় কাছে পৌঁছে যেতেই ইয়ুকা পা পিছলে মেঝের উপর উলটে পড়ল।
“ইয়ুকা!” আমি চিৎকার করলাম। থামার চেষ্টা করলাম, কিন্তু অনেক জোরে দৌড়াচ্ছিলাম, সহজে থামতে পারলাম না। দরজার কাছে রাখা জুতায় লেগে বাড়ি খেলাম দরজায়, তারপর পড়ে গিয়ে থেমে গেলাম।
আমি ঘুরে উঠে ইয়ুকার পাশে গিয়ে দাঁড়াতে চাইলাম। কিন্তু আমার পাগুলো যেন ভয়ে জমে গেছে।
লোকটা ইয়ুকার সামনে দাঁড়িয়েছিল, গলা দিয়ে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে, আমার দিকে তাকিয়ে আছে। দেখতে ভয়াবহ লাগছিল। সে কিছু একটা বলছিল কিন্তু কথাগুলো বোঝার অবস্থায় ছিল না।
সে আমার দিকে এগিয়ে এল, দু-হাত সামনে বাড়ানো যেন আমি পালিয়ে যেতে না পারি।
আমি নড়তে পারছিলাম না। দরজায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম। ইয়ুকাকে একা ফেলে বেরিয়ে যাওয়ার প্রশ্নই আসে না।
এখন আমি কি করব? চিন্তা করে কোন কুল কিনারা পাচ্ছিলাম না। ক্রোধ আর হতাশা আমাকে পেয়ে বসেছিল। লোকটা আমাকে আরেকবার তাকে আক্রমণ করার কোন সুযোগই দেবে না।
আমি পরাজয় মেনে নেয়ার জন্য তৈরি হয়ে গেলাম।
লোকটা ইয়ুকাকে ঘৃণা করত, ওর সাথে খারাপ অনেক কিছু করেছিল, অথচ আমি এতটাই দূর্বল ছিলাম যে ওকে রক্ষা করতে পারলাম না। যত কিছুই চেষ্টা করি না কেন আমি আসলে দূর্বল। যদি আরেকটু শক্তিশালী হতাম তাহলে হয়তো ইয়ুকাকে রক্ষা করতে পারতাম লোকটার কাছ থেকে…
হাতগুলো প্রায় আমার কাছে পৌঁছে গিয়েছিল।
মেঝেতে পড়ে থাকা অবস্থা ইয়ুকা তাকাল আমার দিকে।
“দুঃখিত, আমি পারলাম না,” ফিসফিসিয়ে বললাম তাকে। ওর থেকে চোখ সরিয়ে ফেললাম। মাথা নামিয়ে অন্তিম মুহূর্তের জন্য অপেক্ষা করছিলাম।
আলো নেভানো থাকলেও জানালা দিয়ে বাইরের আলো এসে ঘরটা আলোকিত করে তুলেছিল। মাথা নিচু করে আমি দেখতে পাচ্ছিলাম লোকটার হাতের ছায়া আমার দিকে এগিয়ে আসছে। হলওয়ে থেকে দরজার কাছে ছায়াটা খালি লম্বাই হচ্ছে।
দুঃখিত, আমি তোমাকে রক্ষা করতে পারলাম না… ছায়ার সাথে সাথে গলা থেকে গড়িয়ে পড়া রক্তের ফোঁটাও সামনে এগিয়ে আসছিল। সামনে পড়ে থাকা জুতার উপরও কয়েক ফোঁটা পড়ল।