আমি যেখানে লুকিয়ে ছিলাম সেখান থেকে পুরো লাইনটা শুনতে পাইনি। কাল, শনিবার সকালে কি কিছু হতে চলেছে?
তারা কি আবার একই জিনিস করবে?
আমি মেয়েটার বাসার দিকে গেলাম, হাতে ক্যামেরা। ওর বাসা কোথায় তা আমার জানা আছে। সেদিন রাস্তায় দাঁড়িয়ে দেখেছি কোন বাসায় ও আর কুকুরটা ঢুকেছিল। ওইটাই নিশ্চয়ই ওর বাসা। আমার প্ল্যান হল চুপচাপ ওদেরকে ফলো করা আর ওরা কী করে তা দেখা।
ঘর থেকে বের হওয়ার পর পরই খেয়াল করলাম কিছু একটা ভুলে গিয়েছি। আমার সাথে ওয়ালেট আর ক্যামেরা আছে। পকেট হাতড়ে উপরে আমার রুমের জানালার দিকে তাকালাম। ছুরিটা ভুল করে রুমে ফেলে এসেছি।
ছুরিটা আনতে আবার উপরে যাব? কোন কাজে তো লাগে না। নাকি সোজা মেয়েটার বাড়ি যাব?
সময় নষ্ট করতে চাইছিলাম না। না ফিরে যাওয়াই সহজ হতো। কিন্তু এসব ভাবলেও ফিরে গিয়ে বুককেসের পেছন থেকে লুকানো ছুরিটা বের করলাম। ছুরির ফলার সাদা উজ্জ্বলতা দেখে নিজের হাত কাটার ঝোঁকটা অনেক কষ্টে দমালাম। লেদারের খাপে ছুরিটা ভরে পকেটে নিয়ে বাসা থেকে বের হয়ে এলাম আমি। প্রচণ্ড পিপাসা বোধ হচ্ছে। ছুরির ফলাটা যেন শুকনো মরুভূমির মত আমার ভেতর থেকে সব পানি শুষে নিয়েছে।
পুবদিকে তাকিয়ে দেখি রক্ত বর্ণ ধারন করেছে আকাশ।
***
সকাল হয়ে গিয়েছে।
চোখে আলো পড়তেই আমি আর ইয়ুকা জেগে উঠলাম। পর্দার ফাঁক দিয়ে সরু একটা আলোক রশ্মি এসে কার্পেট, বিছানা, ফুটোন পার হয়ে আমাদের মুখের উপর পড়ছে। এক মুহূর্তের জন্য আমরা একজন আরেকজনের দিকে তাকালাম।
আগে ইয়কার সাথে একসাথে ঘুম থেকে উঠতে মজা লাগত। একজন আরেকজনকে গুতোগুতি করতে করতে ভাবতাম আজকে কি কি খেলা যায়। সেই সময়টা আমি কখনো ভুলতে চাই না। যদি আমাদেরকে আলাদা করে ফেলা হয় তবুও আমি ওকে সবসময় এভাবে মনে রাখতে চাই।
সূর্যের আলোয় ভেসে থাকা ধুলোর দিকে তাকিয়ে আমরা নিজেদের মনস্থির করে বিছানা থেকে উঠে পড়লাম। দরজা খুলে বাইরে তাকালাম আমি।
আম্মুর রুম থেকে লোকটার নাক ডাকার শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। বাসায় এলে সে সবসময় ঐ রুমে ঘুমাত। ভোরবেলা উঠে কাজে চলে যেত আম্মু। আর লোকটা একা একা সারা সকাল নাক ডেকে ঘুমাত।
ইয়ুকা আর আমি আস্তে আস্তে পা ফেলে হলওয়ে পার হয়ে বেডরুমের সামনে গেলাম। আম্মুর রুমটা বাড়ির একদম পেছন দিকে, হল আর রুমের মধ্যে একটা স্লাইডিং ডোর আছে। কিন্তু দরজাটা সকালে লাগাতে আম্মু ভুলে গিয়েছিল। যেটুকু খোলা আছে তা দিয়ে ভেতরে ঢোকা আমার জন্য কোন ব্যাপারই না।
ফাঁক দিয়ে নাক ঢুকিয়ে আমি পুরো রুমটা লক্ষ্য করলাম।
তাতামির উপর একটা ফুটোন বিছানো ছিল। সেখানে লোকটা চিত হয়ে ঘুমাচ্ছে। মুখ অর্ধেক হা করা, গলার অংশটা পুরো উন্মুক্ত। দাঁড়ানো অবস্থায় লোকটাকে দেখতে দৈত্যর মত লাগে, ঐ অবস্থায় আমি কখনো ওর গলা পর্যন্ত পৌঁছাতে পারতাম না। কিন্তু এখন ঘুমে বিভোর বলে ওর গলা আমার নাকের ডগায় চলে এল।
কোন শব্দ না করে আমি দরজা দিয়ে পিছলে ভেতরে ঢুকে পড়লাম। হাঁটার সময় কাঠের তাতামি একটু ক্যাঁচকোঁচ শব্দ করল। ইয়ুকা দরজার কাছে দাঁড়িয়ে দেখছে। ওকে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত লাগছে আমার।
আমি লোকটার মাথার কাছে পৌঁছে গেলাম। সে তখনো কিছু টের পায়নি। ঘুম ভাঙার কোন লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। চোখ বন্ধ। ফুটোনের অর্ধেকটা পেটের উপর উঠে আছে। নিঃশ্বাসের সাথে সাথে ফুলে উঠে আবার নেমে যাচ্ছে।
চোখের কোনা দিয়ে কিছু একটা নড়তে দেখলাম। জানালার দিকে তাকিয়ে দেখি পর্দার পেছন থেকে একটা ছায়া সরে গেল।
আমার চেহারা খেয়াল করল ইয়ুকা। ওকে হতভম্ব দেখাল, মুখ শুকিয়ে গেছে।
জানালার বাইরে কি কেউ ছিল? নাকি পর্দা নিজে নিজে নড়েছে? হতে পারে গাছের ছায়া ছিল? যাই হোক আমি চিন্তাটা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেললাম। সামনে শোয়া মানুষটাকে নিয়েই আমার সমস্ত চিন্তা এখন।
লোকটার মুখের দিকে তাকাতেই আমার মনে পড়ল সে কিভাবে ইয়কাকে কষ্ট দিচ্ছিল। ক্রোধে আমার মন বিষিয়ে উঠল এবার।
ঘুরে ইয়ুকার দিকে তাকালাম।
শব্দের কোন প্রয়োজন নেই আমাদের মধ্যে। আমি জানতাম সে কী চায়, ওর চোখে সবকিছু স্পষ্ট পড়তে পাচ্ছি।
আস্তে করে আমার চোয়াল হা করলাম। কোন ইতস্তত করলাম না। এই কাজ আমি আগে অনেকবার করেছি ব্রিজের নিচে।
কামড় বসালাম।
আমার দাঁতগুলো লোকটার গলায় ঢুকে গেল। চামড়া কেটে রক্ত বেরিয়ে এল। আমি আরো গভীর কামড় দিয়ে ওর টুটি ছিঁড়ে ফেলতে চেয়েছিলাম কিন্তু দেখা গেল মানুষের গলা আমার ধারনার চেয়ে অনেক বেশি শক্ত। শক্ত কিছুতে দাঁত আটকে গেল, বেশি গভীরে ঢুকল না।
লোকটা চোখ খুলে উঠে বসল, আমার দাঁত তখনো তার গলায় বিধে আছে। উঠে বসাতে আমি কামড় দেয়া অবস্থায় ঝুলতে লাগলাম। লোকটা আমার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে চিৎকার করার চেষ্টা করল। গলার গুরুত্বপূর্ণ অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার কারনে, তেমন একটা আওয়াজ বের হল না। সে আমার মুখে ঘুষি মারল কিন্তু তাও আমি ঝুলে থাকলাম।
লোকটা উঠে দাঁড়িয়ে ঝাঁকি দিয়ে আমাকে ছাড়ানোর চেষ্টা করল। তখন আমি ছিটকে তাতামির উপর পড়ে ডিগবাজি খেলাম।
সেই মুহূর্তে মনে হল যেন চারপাশের সময় থেমে গিয়েছে।