বাসায় ফেরার পর মারিনোর মনে পড়ল নোটবুকটার কথা। পকেট থেকে বের করে পড়তে শুরু করল সে।
“আমি দুবার বাথরুমে গিয়েছিলাম। প্রথমবার নোটবুকটা ওখানে ছিল। বৃষ্টি শুরু হওয়ার পর কাস্টমাররা ভেতরে আটকা পড়ে। দ্বিতীয়বার বাথরুমে যাওয়ার সময় নোটবুকটা পাই। এর অর্থ হলো, খুনি তখন কফি শপের ভেতর ছিল। ধারে কাছেই কোথাও থাকে সে।” বুকের সামনে দুহাত ভাঁজ করে বলল।
আমরা যেখানে থাকি তার থেকে দু-তিন ঘন্টার দূরত্বে লাশ দুটো পাওয়া গিয়েছে। সুতরাং এখানে খুনির বাস করা অসম্ভব কিছু নয়। তবু কেন জানি ব্যাপারটা মেনে নিতে ইচ্ছা হচ্ছিল না।
এই কেস নিয়ে হয়তো বছরের পর বছর কথা চলবে। রহস্যের সমাধান হলেও ভয়াবহ বিভৎসতার কারনে ব্যাপারটা পরিস্কার। পুরো দেশের সবাই এই নিয়ে কথা বলছে-এমনকি বাচ্চারাও এই কাহিনী জানে। যে কারনে খুনি ধারে কাছে কোথাও থাকে বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছিল।
“এমনও তো হতে পারে খবর দেখে কেউ কল্পনা করে লিখেছে?”
“বাকিটা পড়, মোরিনো আত্মবিশ্বাসের সুরে বলল।
***
আগস্ট ৫
মিজুগুশি নানামি নামে একটা মেয়েকে রাইড দিলাম। স**** মাউন্টেনের কাছে একটা সোবা শপে তার সাথে পরিচয়।
পাহাড়ের দক্ষিণ দিক দিয়ে উঠে আমরা বনের ভেতরের মঠে গেলাম। সে আমার সাথে বনের ভেতর গেল।
***
নোটবুকের মালিক বনের ভেতর মিজুগুশি নানামি নামের একজনকে ছুরি দিয়ে পেটে কুপিয়েছে।
নোটবুকে সে গিজগিজ হাতের লেখায় লিখেছে, কিভাবে শিকারের শরীর কাটা হয়েছে। কিভাবে সে তার চোখগুলো টেনে বের করে এনেছে, পেটের ভেতরের রঙ কিরকম ছিল, যাবতিয় বর্ণনা দেয়া আছে।
সে মিজুগুশি নানামিকে বনের ভেতর ফেলে এসেছে।
“তুমি কি এই মিজুগুশি নানামির নাম শুনেছ?” মোরিনো বলল।
আমি মাথা নাড়লাম।
মেয়েটার লাশ আবিস্কারের কোন খবর পাওয়া যায়নি এখনো।
২
মোরিনোকে আমি খেয়াল করি দ্বিতীয় বর্ষ শুরুর পর। আমরা একই ক্লাসে ছিলাম। প্রথমে ভেবেছিলাম ও বোধহয় আমার মতই কারো সাথে মিশতে চায়না, একাকি জীবন নিয়ে চলতে চায়। এমনকি বিরতির সময় কিংবা হল দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময়ও সে লোকজনকে এড়িয়ে চলে। কখনো কোন আড্ডায় ঢোকে না।
আমাদের ক্লাসে শুধু আমরা দুজন এমন ছিলাম। অবশ্য এটা বলা যাবে না যে, আমি যেভাবে আমার ক্লাসমেটদের উৎসাহ নিয়ে বিরক্ত, সেও সেরকম। আমার সাথে কেউ কথা বলতে আসলে কথা বলি। হালকা মজা করে ব্যাপারটাকে বন্ধুত্বপূর্ণ পর্যায়ে রাখি। সাধারণ জীবনযাপনের জন্য নমূনতম যতটুকু করা দরকার করি। কিন্তু এসব কিছুই করি উপরে উপরে, আমার হাসির পুরোটাই আসলে মিথ্যে, পুরোপুর বানোয়াট।
প্রথমবার আমরা যখন কথা বলি, মোরিনো সোজা আমার ভেতরের রূপটা দেখে ফেলেছিল।
“আমাকে ওরকম হাসি দেয়া শেখাবে?” স্কুলের পর আমার সামনে এসে ও সরাসরি বলেছিল, মুখে কোন রকম কোন অভিব্যক্তি ছাড়াই। সে নিশ্চয়ই আমাকে ভেতরে ভেতরে ঘৃণা করত।
এটা ছিল মে মাসের শেষের দিকের কথা। এরপর থেকে আমরা মাঝে মাঝে কথা বলতাম।
মোরিনো স্রেফ কালো রঙের পোশাক পরত-পায়ের জুতো থেকে মাথার লম্বা একদম সোজা কালো চুল পর্যন্ত সব গাঢ় রঙ। উল্টোদিকে ওর চামড়ার মত ফ্যাকাসে সাদা রঙ আমি আর কারো দেখিনি। দেখে মনে হত সিরামিকের তৈরি। ওর বাম চোখের নিচে একটা ছোট্ট তিল ছিল, অনেকটা ক্লাউনের মুখের মত দেখতে। এতে চেহারায় একটা রহস্যময়ি ভাব এসেছিল।
সাধারণ মানুষের তুলনায় ওর চেহারায় অভিব্যক্তি খুবই কম বদলাত, কিন্তু বদলাত। যেমন, সে হয়তো একজন খুনির উপর একটা বই পড়ছে, যে কিনা রাশিয়াতে বায়ান্ন জন নারী-শিশুকে হত্যা করেছে। বোঝা যেত ও বইটা পড়ে মজা পাচ্ছে। এই অভিব্যক্তির সাথে ক্লাসে বসে থাকা অবস্থায় বিষণ্ণ সুইসাইডাল অভিব্যক্তির মিল নেই। ওর চোখগুলো তখন জ্বলজ্বল করত।
একমাত্র ওর সাথে কথা বলার সময় আমি কোন ভান করতাম না। অন্য কারো সাথে যদি এভাবে কথা বলতাম তাহলে তারা অবাক হত-কেন আমার চেহারায় কোন অভিব্যক্তি নেই, কেন আমি হাসি না। কিন্তু মোরিনোর সাথে কথা বলার সময় এসবের কোন প্রয়োজন নেই। আমার ধারণা ও আমার সাথে একই কারনে কথা বলত।
আমাদের দুজনের কেউই লোকজনের মনোযোগ আকর্ষণ করতে পছন্দ করতাম না। আমরা আমাদের প্রাণবন্ত ক্লাসমেটদের ছায়ায় লুকিয়ে নিজেদের নিশ্চুপ জীবন যাপন করতাম।
তারপর এল গরমের ছুটি। আর সাথে এই নোটবুক।
***
যেদিন ও আমাকে নোটবুকটা দেখাল, সেদিনই পরে আমরা স্টেশনে দেখা করলাম আর স**** মাউন্টেনে যাওয়ার ট্রেনে চড়ে বসলাম।
আগে আমরা কখনো স্কুলের বাইরে দেখা করিনি। তাই এবারই প্রথম ওকে ইউনিফর্ম ছাড়া দেখলাম। সে যথারীতি কালো পোশাকই পরে ছিল। আমিও কালো পোশাক পরেছি। আর ওর মুখ দেখে বুঝলাম ও তা খেয়ালও করেছে।
ট্রেনে লোকজন প্রায় ছিলই না, যারা ছিল তারাও চুপচাপ। আমরাও কোন কথা বলিনি, যার যার বইয়ে নাক ডুবিয়ে বসেছিলাম। ও পড়ছিল শিশু নির্যাতনের উপর একটা বই, আর আমি পড়ছিলাম বিখ্যাত এক শিশু অপরাধির পরিবারের লেখা একটা বই।
ট্রেন থেকে নেমে স্টেশনের কাছের সিগারেটের দোকানে বসে থাকা এক বুড়িকে জিজ্ঞেস করলাম স****মাউন্টেনের কাছে কয়টা সোবা শপ আছে। তিনি বললেন একটাই আছে, আর আমরা যেখানে আছি সেখান থেকে কাছেই সেটা।