এমনকি দিনে হাঁটতে বের হলেও আমরা আর আগের মত ছোটাছুটি করতাম না। খেলাধুলা করতাম না আগের মত। শুধু কুকুরওয়ালা ঘরগুলো খুঁজতাম। রাতের বেলা শিকার করা সহজ ছিল।
ইয়ুকা আমাকে নির্দেশ দিয়েছিল কী করতে হবে। আমি জানি না এর পেছনে কারণ কি ছিল, যাই থাকুক তা অন্তত মজার কিছু ছিল না। ইয়ুকার চোখগুলো আর হাসত না। ওর দুঃখ আর ঘৃণা বাকি সব অনুভূতিগুলোকে ছাপিয়ে গিয়েছিল। ওর নির্দেশ অমান্য করা আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না।
আগেরবারের চেয়ে এবার বাতাস একটু বেশি ঠান্ডা। ব্রিজের উপর বেশ ভালো গাড়ির ভিড়। গাড়িগুলোর আলো আমাদের দিকে ছুটে আসছে, আমাদের ছায়াগুলো বারবার সরে গিয়ে সরু হয়ে হারিয়ে যাচ্ছে অন্ধকারে।
উপর থেকে আমরা ঘাসের দিকে তাকালাম। ওগুলোও অন্ধকারে প্রায় হারিয়ে গিয়েছিল। বাতাসে ঘাসগুলো দুলছে, অন্ধকারের দিকে স্রোতের মত বয়ে যাচ্ছে। ব্রিজের উপরের স্ট্রিট লাইট থেকে আসা মলিন আলোতে আমরা অল্প কিছু দেখতে পাচ্ছি।
ইয়ুকা আর আমি সিঁড়ি দিয়ে নেমে খোলা জায়গাটার দিকে গেলাম। ভালো করে চারপাশের ঘাসের দেয়াল লক্ষ্য করলাম আমি। কেউ কি ওখানে লুকিয়ে আছে? মনে হলো যেন বাতাসে কোন আগন্তুকের গন্ধ পাচ্ছি?
সমস্ত ইন্দ্রিয় খাড়া হয়ে গেল আমার। এমন সময় ইয়ুকা আমাকে ডাকল। সময় হয়েছে।
যে কুকুরটাকে আমরা সাথে করে নিয়ে এসেছিলাম ওটাকে ভোলা জায়গাটার মাঝখানে রাখা হলো। এবারেরটা কুকুরছানার মত ছোট না, আবার পূর্ণ বয়স্ক কুকুরের মত বড় না। শৈশব মাত্র শেষ হতে যাচ্ছে ওটার। কুকুরটা মুখ তুলে অবাক হয়ে আমাদের দেখল। আসার পথে কুকুরটাকে আমরা চুরি করেছিলাম।
আমরা যখন কুকুরগুলোকে চুরি করি ওরা তখন চিৎকার করে ওদের মালিকদের ডাকডাকি শুরু করে। তখন খাবার দিয়ে আমরা সেগুলোকে শান্ত করি।
ইয়ুকা এক কোনায় সরে গেল। ও সবসময় ওখানে বসে পুরো দৃশ্যটা দেখে।
আমি আমার প্রতিপক্ষর চোখে চোখ রাখলাম, ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য তৈরি। কুকুরটা আমার চোখের দিকে তাকিয়ে কুঁকড়ে গিয়ে মাথা নিচু করে ফেলল। আমার ইন্দ্রিয়গুলো সম্পূর্ণ সজাগ, ইয়ুকার আদেশের জন্য অপেক্ষা করছে।
আমার প্রতিপক্ষের কোন ধারণা নেই ওর জন্য সামনে কী অপেক্ষা করছে। ভয় পেয়ে কু-কু করছিল-নিজের মালিককে খুঁজছিল সে।
এক দফা ঠান্ডা বাতাস শব্দ করে বয়ে গেল ঘাসের মধ্যে দিয়ে। তারপর নিরবতা নেমে এল। ব্রিজের উপরে গাড়ির স্রোতও থেমে গেল মনে হয়, আমার কানে কোন শব্দ আসছে না। সমস্ত নিস্তব্ধতার মাঝেও আমি উত্তেজিত বোধ করছি। বাতাসে চড়চড় শব্দ করে উঠল। ছোট গর্তটা ধ্বংস আর মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করছে আর আমি আমার স্নায়ু টানটান করে শুরু করার জন্য অপেক্ষা করছি।
আমার সামনের কুকুরটা নার্ভাস হয়ে আমার দিকে তাকাচ্ছে। বাতাসের টানটান উত্তেজনা টের পেয়ে সে গুটিয়ে গেছে। আবারো করুণভাবে কুউকুউ করছে।
ইয়ুকা ছোট কিন্তু স্পষ্ট করে নির্দেশ দিল : “আক্রমণ করো!”
আমি ছুটে সামনে গেলাম। অপ্রস্তুত কুকুর আর আমার মধ্যে দূরত্ব মুহূর্তেই কমে গেল। আমাদের কাঁধের মধ্যে সংঘর্ষ হলে কুকুরটা ধাক্কা খেয়ে একদিকে গড়িয়ে পড়ল। আমি হুঙ্কার দিলাম। আমার প্রতিপক্ষ দাঁত বের করে দেখাল, কিন্তু তখনো সে বিভ্রান্ত, বুঝতে পারছে না কী হচ্ছে। ওর চোখে সেটা স্পষ্ট পড়া যাচ্ছে।
আমার হৃদপিণ্ড জোরে জোরে বাড়ি খেতে লাগল। পায়ের নিচের মাটি আর বয়ে যাওয়া বাতাস আমি স্পষ্ট অনুভব করছি। আমার মনে শুধু খেলা কাছে প্রতিপক্ষ আর আমার মধ্যের দূরত্বটা পার হতে আমার কতক্ষন লাগতে পারে।
কুকুরটা ছোটখাট নড়াচড়া থেকে আন্দাজ করার চেষ্টা করছিলাম ওর পরবর্তি পদক্ষেপ কোনদিকে হতে পারে। এখন পর্যন্ত অনেকগুলো লড়াইয়ের অভিজ্ঞতা হওয়ায় আমি এ ব্যাপারে দক্ষ হয়ে উঠেছি।
কিন্তু মনে মনে আমার খারাপ লাগছে। আর কতদিন ইয়ুকা আমাকে এসব করতে বাধ্য করবে? আমি সত্যি সত্যি কোন খুন করতে চাই না। সারা জীবনে কখনো ভাবতেও পারিনি আমার চোয়াল কখনো এই কাজে ব্যবহৃত হবে।
করটা ডানে সরল। কিন্তু আমি সেটা আগেই বুঝতে পেরেছিলাম সুতরাং আমিও ওর সামনেই চলে এলাম। বাতাসে ওর লোম ছড়িয়ে পড়ল। ছিটকে পড়ল রক্ত। টলতে লাগল ওটা। অন্ধকার আমাদের ঘিরে ধরুল যেন।
আরো কিছুক্ষণ লড়াই করলাম আমরা। তারপর ইয়ুকা উঠে দাঁড়াল।
“শেষ করে দাও!” ঘৃণাভরা নির্দেশ দিল সে। ঐ অনুভুতিগুলো আসলে ঐ লোকটার জন্য, আর সে আসার পর থেকেই ইয়ুকা আমাকে এসব করতে বাধ্য করছে। তার সব কষ্ট সে এভাবে আমাকে খুন করতে বাধ্য করার মাধ্যমে মুক্ত করছে।
রক্তাক্ত কুকুরটার দিকে এগুতে এগুতে আমি ইয়ুকার দিকে তাকালাম, তারপর হুঙ্কার ছাড়লাম। আমার হুঙ্কার ব্রিজের নিচে প্রতিধ্বনি তুলল। আমার মাথা গরম হয়ে উঠেছে। এরকম কেন হচ্ছে? কেন আমরা আগের মত হাসিখুশিভাবে খেলাধুলা করতে পারছি না?
কুকুরটা কেঁপে উঠে অন্ধকারের ভেতর নিজেকে লুকানোর চেষ্টা করল। বাঁধা দেয়ার কোন ক্ষমতা আর নেই। কোনমতে দাঁড়াতে পারছে, মৃত্যুভয়ে খরখর করে কাঁপছে ওটা।
আমার এখন এর সমাপ্তি টানতে হবে, নিজের মনে বলতে বলতে আমি গরপেয়ে প্রাণীটার দিকে এগিয়ে চোয়াল হা করে ওর ঘাড়ে কামড় বসালাম। আমার দাঁত চামড়া ভেদ করে গভীরে ঢুকে গেল। গরম রক্ত ছিটকে এসে মুখ ভরে গেল আমার।