“কুকুর পছন্দ করে এমন একজনের সাথে দেখা করতে যাচ্ছি, তুমি আসতে চাও?”
“যেতে পারলে ভালো হত কিন্তু আমাকে হোমওয়ার্ক করতে হবে।”
“কিন্তু আজকে তো কোন হোমওয়ার্ক নেই।”
“হোমওয়ার্ক মানে বাসায় কাজ আছে। আম্মুর অসুস্থতা আরো বেড়েছে। উনি মৃত্যু শয্যায়।”
“ঠিক আছে, কোন অজুহাতের দরকার নেই। তুমি যদি কুকুর ভয় পাও, তাহলে আমি জোরাজুরি করব না,” বললাম আমি, আর কল্পনার বাইরে একটা প্রতিক্রিয়া পেলাম।
“কি বএছা তৃ-তুমি? কুকুর ভয় পাই মানে? বাজে কথা বোল না! আমি মোটেও ওইসব জিনিস ভয় পাই না!”
ওর কথা শুনে মনে হলো ওকে খেপানো ঠিক হবে না। ওকে শান্ত করার জন্য ক্ষমা চেয়ে ফোন রেখে দিলাম।
আর এখন ঘাসের ভেতর লুকিয়ে আছি আমি।
মাটিতে হাঁটু গেড়ে বসে পকেট থেকে ডিজিটাল ক্যামেরাটা বের করলাম। যা আলো আসছে তা আসছে ব্রিজের উপর থেকে। এই আলোতে কোন ছবি তোলা যাবে বলে মনে হয় না। ক্যামেরার অ্যাপারচার ওপেন করে শাটার স্পিড একদম কমিয়ে দিয়ে ফ্ল্যাশ অফ করে দিলাম। ফ্ল্যাশ ব্যবহার করলে কিডন্যাপার আমার উপস্থিতি টের পেয়ে যাবে, সেটা আমি চাই না।
খুনিকে পুলিশের কাছে ধরিয়ে দেয়ার কোন ইচ্ছে আমার নেই। কিডন্যাপার আমার উপস্থিতি না জানাই ভালো। আমার নিয়ম হলো কোন কিছুতে জড়িয়ে না পড়া। তৃতীয় পক্ষ হিসেবে পাশ থেকে সবকিছু পর্যবেক্ষণ করা। আমি রিপোর্ট না করলে আরো কুকুর কিডন্যাপড হবে, আরো লোকজনের মন খারাপ হবে, কান্নাকাটি করবে। কিন্তু তাতে আমার কিছু আসে যায় না। আমি এরকমই।
যেখানে লুকিয়ে আছি সেখান থেকে ব্রিজ থেকে নেমে আসা সিঁড়ি আর খোলা জায়গাটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। আমার মনে হয় গর্তের কাছে যাওয়ার জন্য কিডন্যাপার খোলা জায়গাটার উপর দিয়েই যাবে, আর সে সময় আমি একটা ছবি তোলার চেষ্টা করব।
নদী দিয়ে বিপুল স্রোতে পানি বয়ে যাচ্ছে। ঘাসের আড়াল থেকে পানি বয়ে যাওয়ার শব্দ শুনতে পাচ্ছি। একটু আগে দেখা কালো নদীর চেহারা মনে পড়ল আমার। ঠান্ডা বাতাস বইছিল, আশেপাশের ঘাস দুলছিল। একটা ধারালো ঘাস খোঁচা লাগাল আমার গালে।
ঘড়িতে যখন বারোটা বাজে তখন ব্রিজের উপর একটা ছায়া দেখা গেল। সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে এল ছায়াটা। আমি মাথা নামিয়ে ধীরে ধীরে শ্বাস ফেলছিলাম নিজের উপস্থিতি আড়াল করার জন্য।
ছায়াটা সিঁড়ি বেয়ে নিচে এসে ঘাসের আড়ালে অদৃশ্য হয়ে গেল। সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় লোকটা ছায়ার মধ্যে থাকায় দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু খোলা জায়গাটায় আসার পর ব্রিজের আলোয় তাকে আমি স্পষ্ট দেখতে পেলাম।
একটা মেয়ে আর একটা কুকুর। মেয়েটা খুবই শুকনো আর ছোট খাট, কাঁধ পর্যন্ত চুল। কুকুরটা একটা গোল্ডেন বিট্রাইভার। সেদিন মোরিনোর সাথে যাওয়ার সময় যাদেরকে দেখেছিলাম সেই মেয়ে আর কুকুরটাই।
মেয়েটার কোলে আরেকটা ছোট কুকুর। কুকুরটা কুকু করে ছাড়া পাওয়ার চেষ্টা করছে। কিন্তু মেয়েটার কুকুর কোলে নেয়ার অভ্যাস আছে, মোচড়ামুচড়িতে হাত থেকে ফেলে দিল।
ক্যামেরা রেডি।
***
আমি আর ইয়ুকা প্রথম যেদিন ব্রিজের নিচের খোলা জায়গাটা খুঁজে পাই, সেদিন ছিল গ্রীষ্মের অত্যন্ত গরম একটা দিন। আকাশে এক ফোঁটাও মেঘ ছিল না।
ইয়কা আর আমি হাঁটতে বের হয়েছিলাম। সবসময়ের মত খেলাধুলা করছিলাম। যতক্ষণ পর্যন্ত হাঁফ না উঠে যায় ততক্ষন পর্যন্ত দৌড়াচ্ছিলাম। তারপর নদীর পাশের রাস্তায় থেমেছিলাম বিশ্রাম নেয়ার জন্য।
কংক্রিটের রেলিঙ্গে হেলান দিয়ে বিশ্রাম করছিলাম আর নিচের বাসের সমুদ্র দেখছিলাম। হালকা বাতাস বইছিল, মনে হচ্ছিল অদৃশ্য কোন হাত এসে ঘাসগুলো নাড়াচ্ছে।
ইয়ুকা আমাকে ডাকল। আমি ওর দিকে ঘুরে দেখি ও ব্রিজের শেষ মাথায় লাগানো সিঁড়ির দিকে তাকিয়ে আছে।
আমরা যখন নিচে নামছি তখন ওর মনে অ্যাডভেঞ্চারের অনুভূতি টের পাচ্ছিলাম। সিঁড়ির শেষে সবুজের দুনিয়া শুরু। আমরা যত ভেতরে যেতে লাগলাম ঘাসের গন্ধে নাক ভরে উঠল আমাদের।
সাধারনভাবে হাঁটতে ইয়ুকার হয়তো বিরক্ত লাগছিল, যে কারনে ও আমার দিকে একবার তাকিয়ে হঠাৎ সামনে দৌড় দিল। বুঝলাম, ও চাচ্ছে ওর পিছু নিই। আমরা যে হাঁপিয়ে গিয়েছি তা ভুলে গিয়ে বাসের ভেতর দিয়ে আবার দৌড়াদৌড়ি শুরু করলাম।
গরমের দিন, একসময় আমি ঘেমে সেদ্ধ হয়ে গেলাম। তারপরেও ঘাসের ভেতর ইয়ুকার পিছুপিছু দৌড়াচ্ছিলাম। ওর হাসি শোনা যাচ্ছিল, আমি শব্দের দিকে ছুটে যাচ্ছিলাম, ও আরেকদিকে পালাচ্ছিল।
হঠাৎ আমরা একটা খোলা জায়গায় এসে পড়ি। মনে হয় একটা নতুন দুনিয়া। ঘাসের গন্ধ কম, চারপাশে হালকা বাতাস বইছে। খোলা জায়গাটায় কোন ঘাস নেই।
ইয়ুকাই প্রথম জায়গাটা খুঁজে পেল। খোলা জায়গাটার মাঝখানে ও অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। এরপর আশেপাশে তাকাতে গিয়ে ও দেখল আমি ঘাসের দেয়ালের ভেতর দিয়ে বেরিয়ে আসছি। প্রথমে জায়গাটা পেয়ে আমাদের দুজনেরই বোকা বোকা লাগছিল। পরে মনে হলো যেন বিশেষ কিছু একটা খুঁজে পেয়েছি। আমি ওর চোখে আনন্দের ঝলক দেখতে পাচ্ছিলাম।
কতদিন আগের ঘটনা এটা? মনে হচ্ছে যেন কত আগে ঘটেছে।
খোলা জায়গাটা খুঁজে পাওয়ার কিছুদিন পরেই লোকটা নিয়মিত আসতে লাগল। সেই সাথে ইয়ুকা আর আমিও আমাদের মাঝরাতের হাঁটাহাঁটি শুরু করলাম। দিন দিন বাতাস ঠান্ডার দিকে যাচ্ছিল। সেদিনের মত গ্রীষ্মের উষ্ণতা আর অনুভব করতে পারছিলাম না।