ওর জুনিয়র স্কুল আর ক্রাম স্কুলের মধ্যে একটা নদী পড়ে। নদীর উপর কংক্রিটের তৈরি একটা বড় ব্রিজ আছে, গাড়ি চলাচল করে। পথচারি আর সাইকেলের জন্য আলাদা লেন আছে।
“সাইকেলের ঝুড়িতে আমার ভোয়ালে আর ব্যাগ রাখা আছে।”
নীল-সাদা রঙের একটা ভোয়ালে যেটা সে নিয়মিত ব্যবহার করে। পাশ দিয়ে একটা ট্রাক যাওয়ার সময় বাতাসের তোড়ে ভোয়ালেটা উড়ে গিয়ে নিচে পড়ল। ও রেইলিং দিয়ে তাকিয়ে দেখে তোয়ালেটা নদীতে পড়েনি, তীরের কাছে ঘাসের উপর আটকে আছে।
“আমি নিচে গেলাম ভোয়ালেটা তুলে আনতে।”
ব্রিজের শেষ মাথায় একটা সিঁড়ি আছে যেটা দিয়ে নদীর তীরে নামা যায়। সাকুরা নিচে নেমে দেখে চারপাশে লম্বা সুচালো সবুজ ঘাস। প্রায় ওর সমান লম্বা। ও সেগুলো সরিয়ে সামনে গেল। ঘাসের বন ঘন হলেও সরিয়ে সামনে যাওয়া যাবে না তা নয়।
“উপর থেকে বোঝা যাচ্ছিল না কিন্তু ব্রিজের নিচে একটা খোলা জায়গা আছে যেখানে ঘাস নেই।” একটা গোলাকৃতির শুকনো জায়গা, চারপাশে ঘাসের দেয়াল। অনেকটা খাঁচার মত।
বিশাল ব্রিজটা ছাদ হিসেবে কাজ করছে। সাকুরা উপরে তাকালে আকাশের অর্ধেকটা দেখতে পেল।
“আমি আমার তোয়ালে খুঁজছিলাম, কিন্তু…” ও পোকামাকরের গুনগুন শব্দ শুনতে পেল-মাছির একটা ঝাঁক। কাছাকাছি যেতে দেখতে পেল মাছিগুলো একটা জায়গা ঘিরে রেখেছে।
“আমি ওদিকেই যাচ্ছিলাম কারন তোয়ালেটা ওদিকেই পড়েছিল..”
যেতে গিয়ে সাকুরা নাকে পচা একটা গন্ধ পেল। মাছির ঝাকের কাছের ঘাস সরিয়ে দেখে পায়ের কাছে একটা গর্ত। গর্ত না বলে বরং ঢালু একটা জায়গা বলাই ভালো। তিন ফুটের মত চওড়া আর তিন ফুটের মত গভীর। আরেকটু হলে ও প্রায় পড়েই যাচ্ছিল সেটার ভেতর। নিচে তাকিয়ে বুঝতে পারল দুর্গন্ধটা কোত্থেকে আসছে…
***
গর্তটা অসংখ্য মাংসের স্তূপ দিয়ে ভর্তি। কোন আকার আকৃতি নেই, টুকরো টাকরা দেখে আমি প্রথমে বুঝতে পারিনি ওগুলো কি ছিল, স্রেফ কালো আর লাল মাংসের স্তূপ।
দুর্গন্ধ উপেক্ষা করে উপুড় হয়ে কাছ থেকে ভালো করে দেখার চেষ্টা করলাম।
চোয়াল, লেজ, ধর-সব কুকুরের। কেঁচোর মত পোকা কিলবিল করছে। ওগুলোর উপর। মাংসের স্তূপের উপর স্তূপ জমে আছে গর্তের ভেতর। ওগুলোর সবগুলোর শরীরে একসময় প্রাণ ছিল। সূর্যের আলোর নিচে কুকুরগুলো একসময় হয়তো তিরিং বিরিং করত। এ এক অদ্ভুত অনুভূতি, মৃত্যু আর ধ্বংস দিয়ে গাঁথা।
গর্তটা থেকে পচা দুর্গন্ধ বের হচ্ছে। লাশগুলোর দিকে তাকিয়ে আমার দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ের কিছু ছবির কথা মনে পড়ল। গর্তটার দৃশ্যর সাথে ঐ ছবিগুলোর বেশ মিল আছে।
আশেপাশে খেয়াল করলাম। সাকুরা যেমন বলেছিল, চারপাশে ঘাস ছাড়া আর কিছু নেই। সূঁচালো ঘাসগুলো উপর দিকে মুখ করে আছে আর ওগুলোর উপর দিয়ে মাছি ভন ভন করছে। মাছিগুলো মনে হয় আমাকে তাদের বন্ধু ভেবেছিল, বার বার মুখে আর গায়ে এসে বসছিল। সূর্যাস্তের আলোয় সব কিছু লালচে দেখাচ্ছে।
সাকুরা যখন ওর আবিস্কারের কথা আমাকে বলল, আমি সাথে সাথে অনুমান করলাম কুকুর কিডন্যাপিং আর গর্তটার মধ্যে কোন সম্পর্ক আছে। যে জায়গাটা খুঁজছিলাম সেটাই এই জায়গা হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি।
আমি ওকে বাসায় পাঠিয়ে দিয়ে ব্রিজের দিকে চলে এলাম। সিঁড়ি বেয়ে নদীর তীরে নেমে ঘাসের ভেতর খোলা জায়গাটা খুঁজে পেতে কোন বেগ পেতে হলো না। একটু দূরেই মাছির মেঘ দেখা যাচ্ছে।
গর্তের ভেতর মার্বেল আর পাভলভের লাশও আছে।
তারপর সেখান থেকে বাসায় চলে এলাম। এখন শুধু রাত নামার অপেক্ষা।
ঘড়িতে যখন রাত দশটা বাজলে পকেটে ছুরিটা নিয়ে রুম থেকে বের হলাম আমি। সাকরা তখনো লাশগুলো দেখার শক কাটিয়ে উঠতে পারেনি। লিভিং রুমের সোফায় শুয়ে মায়ের সাথে টিভি দেখছে। আমি যখন দরজা দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছি মা জিজ্ঞেস করল কই যাই। বললাম শপিং মলে যাচ্ছি। সাকুরা বিড়বিড় করল, “শপিং মলের মাঝরাতের প্রহরি!”
ব্রিজের নিচের খোলা জায়গাটায় ফিরে এলাম। শুক্রবার, সুতরাং ভালো সম্ভাবনা আছে কিডন্যাপারের দেখা পাওয়ার।
হাঁটতে হাঁটতে আমি কল্পনা করার চেষ্টা করলাম এরকম প্রাণী হত্যা করতে কী রকম আনন্দ হতে পারে। কিডন্যাপার যে মরা কুকুরগুলোকে নিয়ে গর্তে ফেলছে তা যেন আমি চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি।
সম্ভব হলে আমি লোকটার কাজ দেখতে চাই। লাশগুলো ফেলার আগে কি রকম আনুষ্ঠানিকতা হয় না হয় তা জানতে আমার কৌতূহল হচ্ছে।
ইর, নির্মম ব্যাপার সবসময় আমাকে আকর্ষণ করে। আমার ক্লাসমেটদের সাথে যেসব আলোচনা হয় কিংবা পরিবারের লোকজনের সাথে যেরকম উষ্ণ আচরণ করি তা আসলে আমার সাথে খাপ খায় না। ওরা কেমন যেন স্থিতিশীল ধরনের। অনেকটা একটা রেডিওর মত, যেটা কিনা ঠিকমত টিউন করা হয়নি।
রাতের বেলায় নদীটা অন্ধকারে একদম কালো হয়ে আছে। যেন তারা শূন্য মহাবিশ্ব এসে ছড়িয়ে শুয়ে আছে এখানে। ব্রিজের আলোতে নদীর পানি খুব কমই আলোকিত হতে পেরেছে। এখন পর্যন্ত কারো উপস্থিতির চিহ্ন দেখা যাচ্ছে না, তার মানে কিডন্যাপার এখনো এসে পৌঁছায়নি এখানে।
আমি সাবধানে সিঁড়ি বেয়ে নেমে ঘাসের ভেতর গিয়ে ঢুকলাম। ঢোকার সময় আসার আগে মোরিনোর সাথে হওয়া টেলিফোনে কথা মনে পড়ল।