***
আমার জানা ছিল লোকটা আজকে আসবে, ঘুমিয়ে পড়া একদম উচিত হয়নি। ইয়ুকার চিৎকারে লাফিয়ে উঠলাম। লিভিং রুম থেকে ওর গলার শব্দ ভেসে আসছে। দৌড়ে গেলাম ওর কাছে।
ও আমার পেছনে লুকিয়ে ছিল। লোকটা নিশ্চয়ই ওকে টেনে লিভিং রুমে নিয়ে গিয়েছে। আম্মু বাসায় নেই। লোকটা ইয়ুকাকে একা পেয়ে গেছে।
ইয়ুকা দলামোচা হয়ে পড়ে গোঙাচ্ছে, শব্দ শুনে মনে হলো ব্যথার সাথে যুদ্ধ করছে ও।
লোকটা ওর মাথার কাছে দাঁড়িয়ে ওর দিকে ভাবলেশহীন মুখে তাকিয়ে আছে। তাকে বিশাল দেখাচ্ছে, মনে হচ্ছে মাথাটা গিয়ে সিলিঙে ঠেকেবে। আর ইয়ুকাকে একদম ক্ষুদ্র লাগছে তার সামনে। মাটিতে পড়ে অসহায়ের মত ব্যথায় গোঙাচ্ছে সে।
আমার মাথার ভেতরটা ক্রোধে জ্বলে উঠল। গলার পুরো জোর দিয়ে আমি একটা হুংকার ছাড়লাম।
লোকটা আমার দিকে ঘুরল, চোখে তার বিস্ময়। এক পা পিছিয়ে ইয়ুকা থেকে সরে গেল সে।
ইয়ুকা ওখানে পড়ে কাতরাচ্ছে, কিন্তু ওর দৃষ্টি আমার উপর। সে দৃষ্টিতে আমি পরিস্কার আমার প্রতি ওর ভালবাসা দেখতে পাচ্ছি। মনের গভীর থেকে টের পাচ্ছি ওকে রক্ষা করার দায়িত্ব আমার।
সামনের দরজা খোলার শব্দ কানে এল, কেউ ডাকছে। আম্মু শপিং থেকে ফিরে এসেছে। এই লোককে এখানে রেখে সে শপিঙে গিয়েছিল!
আমি লোকটার হাতে কাপড় দিতে চেয়েছিলাম, কিন্তু আম্মু আমাকে পেছন থেকে ধরে ফেলল। এক ইঞ্চির জন্য হাতটা ফসকে গেল।
কিন্তু ওটুকু সময় ইয়ুকার জন্য যথেষ্ট ছিল উঠে দাঁড়ানোর জন্য। আম্মু যখন রাগি গলায় কিছু একটা বলছে, ইয়ুকা তখন দৌড়ে দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেল। আমিও ওর পিছুপিছু দৌড়ে গেলাম। দু-জনেই আমরা দৌড়ে বাসা থেকে পালালাম।
যত জোরে সম্ভব আমরা দৌড়ালাম। আম্মু পেছন থেকে আমাদের ডাকছে শুনতে পাচ্ছি কিন্তু ফিরে তাকালাম না। রাতের অন্ধকারের মধ্যে আমরা দৌড়ে মিশে গেলাম।
অন্ধকার রাস্তা, দু-ধারে নিস্তব্ধ ল্যাম্প পোস্টের সারি। শুধুমাত্র আমাদের পায়ের তলার মাটি উজ্জ্বল হয়ে আছে। আমাদের দুজনের ছোট ছায়াগুলো এক ল্যাম্প পোস্ট থেকে আরেক ল্যাম্প পোস্টে ছুটে যাচ্ছে। যতদূর দৃষ্টি যায় চারদিকে শুধু বিস্তৃত রাত। ইয়ুকা সাথে থাকায় কোন ভয় পাচ্ছি না। কিন্তু ওর কথা ভাবলেই আমার কষ্ট হচ্ছে।
ইয়ুকা কাঁদছে না কিন্তু আমি জানি ও ব্যথায় কষ্ট পাচ্ছে। আমিও অনুভব করতে পারছিলাম। মাঝে মাঝে ব্যথা এত বের যাচ্ছে যে, ওকে থেমে থেমে বিরতি নিতে হচ্ছে। আমার খুব খারাপ লাগছে, কিন্তু ওর পাশে থাকা ছাড়া আমার পক্ষে আর কিছু করার নেই।
বিকেলে আমরা যে জন্তুটাকে দেখেছিলাম সেটাই হবে রাতের প্রতিপক্ষ-ইয়ুকা বলেছিল। সেদিন আমরা হাঁটতে বেরিয়ে ওটাকে দেখতে পেয়েছিলাম, সহজে তুলে আনা যাবে। আমরা ঐ বাড়ির দিকে এগুতে লাগলাম।
আমি নিশ্চিত ইয়ুকাও ব্যাপারটা খেয়াল করেছে-জন্তু চুরি করা আর আগের মত সহজ নেই। এখন সবাই তাদের জন্তুকে ঘরের ভেতর রাখে। আমাদেরকে ঠেকানোর চেষ্টা করছে আর কি।
আমার এখন অনেক দুশ্চিন্তা হয়, কেউ যদি দেখে ফেলে আমরা কি করছি?…সেজন্য সবসময় সতর্ক থাকি, কোন ছায়া নড়তে দেখলেও চমকে
ইয়ুকাকে ভয় নেই আমার, আম্মুকেও না। এমনকি ঐ খারাপ লোকটাকেও ভয় পাই না। আমি ভয় পাই অচেনা মানুষকে। আমরা যখন জম্ভগুলি চুরি করে নিয়ে যাই, কেউ একজন আমাদের পেছন পেছন আসে। সে হয়তো একসময় জেনে যাবে, ব্রিজের নিচে আমরা কি করি। তারপর কি হবে অনুমান করা কঠিন কিছু নয়। সবাই জেনে গেলে ইয়ুকা আর আমাকে আলাদা করে ফেলা হবে। আমি না থাকলে ইয়ুকাকে রক্ষা করার জন্য কেউ থাকবে না আর। আমি সেটা হতে দিতে পারি না।
আজকের বাড়িটা দেখতে পাচ্ছি আমরা। রাস্তার আলো বাড়ির ছাদে পড়ায় আশপাশ পুরো অন্ধকারে ডুবে আছে। বিকেলে যাওয়ার সময় আমরা দেখেছিলাম বাড়িটা এক কোণায়, উঠোনের আরেকদিকে, একটা ছোট কুকুর আছে।
“চল,” ইয়ুকা বলল। আমরা সামনে পা বাড়ালাম।
কিন্তু সে মুহূর্তে কিছু একটা চোখে পড়ল আমার, সাথে সাথে মৃদু স্বরে ইয়ুকাকে ডাকলাম। আমরা দুজনেই বরফের মত শক্ত হয়ে গেলাম তখন। ইয়ুকা হতবুদ্ধি হয়ে আমার দিকে তাকাল।
এক মুহূর্ত আগে বাড়িটার বাইরের অন্ধকার অংশে একটা হালকা আলো দেখেছি আমি। খুবই হালকা আলো, অল্প সময়ের জন্য ছিল, কিন্তু ওখানে কেউ আছে নিশ্চিত হওয়ার জন্য যথেষ্ট। আমার সমস্ত ইন্দ্রিয় ঐ নির্দিষ্ট জায়গাটার দিকে কেন্দ্রিভুত। দেখা যাচ্ছিল না কিন্তু কেউ সেখানে দাঁড়িয়ে বাড়িটার উপর নজর রাখছিল। আমার কি ভুল হতে পারে? নাহ, আমি নিশ্চিত কোন ভুল হয়নি।
আজকে বাদ, আমি চোখের দৃষ্টি দিয়ে ইয়ুকাকে বললাম। সে আরেকবার বাড়িটার দিকে তাকিয়ে আমার কথায় রাজি হলো।
সে রাতে আমরা কোন জন্তু চুরি করিনি। ব্রিজের নিচে কিছু সময় কাটিয়ে বাড়ি ফিরে গিয়েছিলাম। ইয়ুকা চাচ্ছিল আমি খুন করি কিন্তু আমাকে তা করতে হয়নি বলে হাফ ছেড়ে বেঁচেছিলাম।
তারপরেও দুশ্চিন্তা হচ্ছে। যে ছায়া আমাদের পিছু নিয়েছে তা এখন আকার ধারন করেছে, নিজের উপস্থিতি প্রদর্শন করেছে। ব্যাপারটা তার মানে আমার কল্পনা ছিল না, একদম বাস্তব ছিল।
৩
মঙ্গলবার রাতে কিডন্যাপারকে ধরার প্ল্যান আমার বৃথা গেল। পরেরদিন, বুধবার, গল্পেরছলে আমি আমার পরিবারের লোকজন আর ক্লাসমেটদের প্রশ্ন করে বের করার চেষ্টা করলাম নতুন কোন কুকুর নিখোঁজ হয়েছে কিনা। কিন্তু সব খোঁজ খবরের পর মনে হলো সে-রাতে কিডন্যাপার কিছু চুরি করেনি। কিংবা চুরি হলেও হয়তো এমন কোথাও হয়েছে যার খবর আমার কাছে আসেনি।