ওর ব্যক্তিত্ব আমার পুরোপুরি উল্টো, বাসার কাজে অনেক সাহায্য করে। কোন কিছুতে সাহায্য করতে বললে কখনো ও ফেলতে পারে না। যেমন, হয়তো আমার মা টিভির সামনে বসে স্নাক্স খাচ্ছে, সাকুরার দিকে তাকিয়ে দু-হাত এক করে বলল, “সাকুরা মা, একটু থালা-বাসনগুলো ধুয়ে দাও না?” সাকুরা প্রথমে রাজি হবে না।
“পারব না! তুমি নিজে কর গিয়ে!”
কিন্তু আমার মা দুঃখি দুঃখি চেহারা করবে, যেন দুনিয়া যেকোন মুহূর্তে ধ্বংস হয়ে যেতে পারে। সাকুরা তা দেখা মাত্র লাফ দিয়ে উঠবে, “ঠিক আছে। ঠিক আছে! কান্নাকাটি কোরো না,” তারপর গিয়ে থালা বাসন ধুবে। ওদিকে মা আবার টিভি দেখায় ব্যস্ত। আমি মাঝে মাঝে চিন্তা করি সাকুরা কি জানে মা অভিনয় করছে? আমার তো মনে হয় সারাজীবন ওকে বুড়ো বাপ-মা পালতে হবে।
সাকুরার একটা বড় গুণ ছিল, অন্তত আমার কাছে তা মনে হলেও ওর কাছে এটাকে অভিশাপ মনে হতো, সেটা হল বেশিরভাগ সময় ওকে একজন সাধারণ মানুষ মনে হতো।
“তুমি কি আবার গেইম সেন্টারে গিয়েছিলে নাকি?” আমাকে দেখে মা দীর্ঘশ্বাস ফেলে জানতে চাইল। ভিডিও গেমস আমার তেমন পছন্দ না, কিন্তু বাসায় দেরি করে ফেরার অজুহাত হিসেবে আমি সেটাকে ব্যবহার করি।
কিচেনে একটা চেয়ার টেনে বসে ওদের রান্নাবান্না দেখতে লাগলাম। ওরা চুপচাপ তাল মিলিয়ে কাজ করে যাচ্ছিল। আমার মা তখন সবজি ফ্রাই করছিলেন, কোন কথা না বলে খালি হাতটা সাকুরার দিকে এগিয়ে দিলেন। আমার বোন ঠিক জানত মা কি চাইছিলেন, সে লবণ এগিয়ে দিল। মা একটু চেখে দেখলেন ফ্রাই ঠিক আছে কিনা। এরপর তিনি মিরিন (রাইস ওয়াইন) চাওয়ার আগেই সাকরা সেটা এনে দিল।
ওরা দুজনেই আমার সাথে কথা বলছিল, আমিও উত্তর দিচ্ছিলাম। ওরা হাসছিল। সাকুরা একটু জোরেই হাসে, হাসতে হাসতে খাবি খায়।
“আমাদের আর হাসিয়ো না, টেবিলটা গোছও। তো তারপর টিচার কি করলেন?” সাকুরা বলল।
আমি তখন স্কুল নিয়ে বলছিলাম। মাঝে মাঝে আমি খেয়াল হারিয়ে ফেলি কী নয়ে কথা বলছি আর কেনই বা আমার আশেপাশের সবাই হাসাহাসি করছে। যেসব গল্প বলি সেগুলো সেই জায়গায় বসে তখনই বানানো। কিন্তু কখনো ধরা পড়িনি বা কোন সমস্যা হয়নি।
দেখে হয়তো মনে হবে আমি চমৎকার একটা হাসিখুশি পরিবারের সদস্য। বাসার লোকজন মনে করে আমি খুবই মিশুক ধরনের একটা ছেলে-যে কিনা পড়াশোনায় তেমন ভালো না কিন্তু লোকজনকে ভালো হাসাতে পারে।
কিন্তু আমার কাছে যা মনে হয় তা হলো, আমার মা-বোনের সাথে আমার আসলে কোন কথা হয় না। কিছুক্ষণ পরেই আমি ভুলে যাই কি বলছিলাম। মনে হয় যেন আমি সেখানে পাথরের মত বসেছিলাম, কোন কথা ছাড়া, আর আশেপাশের সবাই নড়াচড়া করছে, ফেটে পড়ছে, কোন অদ্ভুত পরাবাস্তব স্বপ্নের মত।
“কিরির কুকুর এখনো নিখোঁজ, থালাবাসন ধুতে ধুতে সাকুরা বলল। আমার কান নড়ে উঠল, এতক্ষন কিছু শুনছিলাম না, হঠাৎ মনে হল কানে কিছু ঢুকছে। “ও ভেবেছিল কুকুরটা নিজে নিজে বাড়ি ফিরে আসবে কিন্তু…”
আমি বিস্তারিত জানতে চাইলাম।
সাকুরা জানাল ওর ক্লাসমেটের কুকুর গত সপ্তাহের বুধবার থেকে নিখোঁজ। সবাই ধারণা করছে কিডন্যাপার তুলে নিয়ে গিয়েছে ওটাকে।
“কিডন্যাপার সম্ভবত এক টুকরো সসেজের লোভ দেখিয়ে ওকে তুলে নিয়ে গিয়েছে।”
“ওহ হো,” মা বিড়বিড় করলেন, দোকান থেকে সসেজ কিনতে ভুলে গিয়েছেন তিনি।
“কি কুকুর ছিল? সাইজ কি ছিল?” আমি জানতে চাইলাম।
সাকুরা ভুরু কুঁচকে আমার দিকে তাকাল। আমি ভুলে এমন একটা চেহারা করে ছিলাম যেটা সাধারণত পরিবারের সামনে আমার লুকানো থাকে।
“ক-কি হল?” আমি তোতলাচ্ছিল, চাপা দেয়ার চেষ্টা।
“কুকুরটা ছিল একটা মাট, কিন্তু খুবই ছোট ধরনের।”
হঠাৎ মনে হলো, পাভলভের মালিককে এই প্রশ্নটা করতে আমি ভুলে গিয়েছি। কথা শেষ হতেই দৌড়ে দরজার দিকে ছুটে গেলাম। তখনো স্কুলের ইউনিফর্ম আমার পরনে। মা পেছনে থেকে ডাকতে লাগলেন, ডিনারের সময় প্রায় হয়ে গিয়েছে।
পাভলভের বাসায় যখন পৌঁছলাম তখন চারদিকে অন্ধকার হয়ে এসেছে। বেল বাজাতে একই ভদ্রমহিলা আবার দরজা খুললেন। এখন অবশ্য কোলে বাচ্চাটা নেই। আমাকে দেখে তিনি বেশ অবাক হলেন।
“আপনাকে আবার বিরক্ত করার জন্য দুঃখিত। কিন্তু একটা প্রশ্ন করতে ভুলে গিয়েছিলাম। পাভলভের সাইজ কেমন ছিল?”
“এটা জানার জন্য আবার এতদুর এসেছো?” হতবুদ্ধি হয়ে বললেন। তারপর জানালেন পাভলভ পূর্ণ বয়স্ক কুকুর ছিল না, ছোটখাটই ছিল।
“তার মানে কুকুরছানার চেয়ে একটু বড়?”
“হ্যাঁ। যদিও ওর প্রজাতির কুকুর অনেক বড় হয়। যেকারনে ডগ হাউজটা বড় কেনা হয়েছে।”
আমি তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে বিদায় নিলাম। কিডন্যাপার যখন কুকুরগুলো চুরি করছিল, ফিতেগুলো নেয়নি। তাহলে কুকুরগুলো কিভাবে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে? কিডন্যাপার নিজের ফিতে নিয়ে এসেছিল? ডগ হাউজ থেকে ফিতেটা খুলে টেনে নিয়ে গেলে ব্যাপারটা কি সহজ হত না? তার মানে কিডন্যাপার কুকুরের গলা থেকে ফিতেটা খুলে কোলে করে নিয়ে গিয়েছে।
এখন প্রশ্ন হল, কেন পাভলভকে চুরি করা হলো, কিন্তু রাস্তার ওপারের চুপচাপ কুকুরটাকে করা হলো না? আমি চোর হলে তো যে কুকুর শব্দ করে তাকেই চুরি করতাম। ব্যাপারটা সবদিক থেকে সহজ হত না?