আমি চারপাশে আরেকবার ভালো করে তাকালাম। রাস্তার দুধারে ঘরবাড়ি। একটা বাড়ির গেটের ভেতর একটা ডগ হাউজ দেখলাম। একদম নতুন। নতুন কুকুর এনেছে নাকি? কুকুরের কোন শব্দ পেলাম না। ভালোমতো শোনার চেষ্টা করলাম।
অনেকক্ষণ সময় লাগল আমার বুঝতে।
ইতিমধ্যে মোরিনো অনেকখানি সামনে চলে গিয়েছে। আমি ওর দিকে এগিয়ে গেলাম কিন্তু ও আবারো থামল। এক হাত তুলে আমাকে সংকেত দিল।
“বিপদ! আমরা আর সামনে এগুতে পারব না।” সে সোজা সামনে তাকিয়ে আছে, দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়াচ্ছে। আমাদেরকে ঘিরে ফেলা হয়েছে,” গোঙানির মত শব্দ করল ও। টেনশন টের পাওয়া যাচ্ছিল ওর কথা বলার মধ্যে।
একটা বাচ্চা মেয়ে আর বড় একটা কুকুর আমাদের দিকে হেঁটে আসছিল।
কুকুরটা গোল্ডেন বিট্রাইভার প্রজাতির। শরীরে সুন্দর পশম। গলায় ফিতে লাগিয়ে মেয়েটা ওকে নিয়ে যাচ্ছিল। ছোট, শুকনো ধরনের একটা মেয়ে, কাঁধ পর্যন্ত লম্বা চুল। চুলগুলো প্রতি পদক্ষেপে দুলছিল। মেয়েটা মনে হচ্ছে মাত্র থার্ড গ্রেডে পড়ে।
আমাদের পাশ কাটিয়ে যাওয়ার সময় মেয়েটার কুকুরের সাথে আমার চোখাচোখি হল-বড়, কালো গভীর চোখ। নিজের ছায়া দেখতে পাচ্ছিলাম সেখানে। মনে হচ্ছিল আমাকে ঐ চোখগুলো টেনে ভেতরে ঢুকিয়ে নেবে, ব্ল্যাকহোলের মত।
মেয়েটা আর কুকুরটা আমাদের পেছনে ফেলে কাছের একটা লাল চালার একতলা বাড়িতে গিয়ে ঢুকল।
“আমি এসেছি,” মেয়েটার গলা শুনতে পাচ্ছিলাম আমি। গোল্ডেন বিট্রাইভারটাও মেয়েটার সাথে সাথে দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকে গেল। সামনের উঠোনে কোন ডগ হাউজ নেই, তার মানে কুকুরটা ঘরের ভেতরেই থাকে।
মেয়েটা আর তার কুকুরটা অদৃশ্য হয়ে গেলে মোরিনো দেয়াল থেকে সরে (এতক্ষন ও দেয়ালের সাথে লেপ্টে ছিল) হাঁটা শুরু করল, যেন কিছুই হয়নি। আমার মনে হচ্ছিল কিছু বলবে, কিন্তু কিছু বলল না। ও এরকমই, দৈনন্দিন জীবনের সাথে খাপ খাওয়ানো ওর জন্য বিশাল সমস্যা।
“আমার কোন ধারনাই ছিল না এই রাস্তায় এত বিপদ,” মোরিনো গজগজ করতে করতে বলল।
আমি জানতে চাইলাম অন্য কোন রাস্তা দিয়ে ঐ বইয়ের দোকানে যাওয়া সম্ভব কিনা, কিন্তু জানা গেল অন্য রাস্তা দিয়ে যেতে হলে অনেক ঘুরে যেতে হবে। মোরিনো ইতিমধ্যে আমাকে সেখানে নেয়ার পরিকল্পনা বাদ দিয়েছে।
ওর পিছু যেতে যেতে আমি আবার নিখোঁজ কুকুরগুলোর কথা চিন্তা করলাম। কেন সপ্তাহে দু-বার? আর কেনই বা শুধু শুক্র আর মঙ্গলবার রাতে? নিখোঁজ কুকুরগুলোর পরিণতি কি?
মোরিনো আর আমি অদ্ভুত সব কেস খুঁজে বের করি, যেগুলোয় জড়িত ব্যক্তিরাও অদ্ভুত-ডার্ক। দুঃখজনক মৃত্যু যা মানুষের হৃদয়কে বিদীর্ণ করে দেয়, যেসব মৃত্যু এতটাই নিষ্ঠুর যে শুনলে লোকজন চিৎকার করে উঠতে চায়-সেরকম যে কোন ঘটনার প্রতি আমাদের সীমাহীন আগ্রহ। আমরা খবরের কাগজ থেকে এসব আর্টিকেল কেটে রাখি। মানুষের মনের গভীরের অন্ধকার কুয়ায় ডুব দিতে ভালো লাগে আমাদের।
বেশিরভাগ মানুষ এধরনের আগ্রহ হজম করতে পারে না-কিন্তু আমাদের কাছে ব্যাপারটা যাদুবিদ্যার মত আকর্ষণীয় মনে হয়।
এইবার অবশ্য কোন অস্বাভাবিক কেস বলা যাবে না, কুকুর হারানোর সাধারণ কেস। কিন্তু ঘটনাগুলো ঘটেছে আমাদের বাসার খুব কাছে। ঘরের পাশের ছোট ঝামেলা বরং অন্য দেশের বড় ঝামেলার চেয়ে বেশি আকর্ষণীয়।
“তুমি কি জাতে আগ্রহি, কে এই কুকুরগুলোকে চুরি করছে?” আমি প্রশ্ন করলাম।
“যদি জানতে পার, আমাকে জানিয়ে, সে তার অভিব্যক্তিহীন চেহারা নিয়ে বলল। আমি ধরে নিলাম সে এর মধ্যে জড়িত হতে চায় না…বিশেষ করে যেখানে কুকুর জড়িত।
***
ইয়কা আর আমি আম্মুর সাথে থাকি। কিন্তু আম্মু কখনো বাসায় থাকে না। সকালে বেরিয়ে যায়, ফেরে গভীর রাতে। সারাদিন আমি আর ইয়কা বাসায় থাকি।
আমি যখন একদম ছোট, তখন থেকে ইয়ুকার সাথে আছি। আমার ভাইদেরকে আমার জন্মের পরই সরিয়ে নেয়া হয়েছিল। তারপর থেকেই আমি ইয়কার সাথে আছি।
বেশিরভাগ সময়ই টিভির সামনে সময় কাটায় ইয়কা। আমি ওর পাশে গিয়ে ওর পিঠে মাথা দিয়ে খবরের কাগজের উপর শুয়ে থাকি।
টিভি দেখতে দেখতে আমরা বিরক্ত হয়ে গেলে উঠে হাত-পা টানটান করি। ইয়ুকা কিচেন আর বাথরুমে ঘোরাঘুরি করে, আমি পিছে পিছে থাকি।
তারপর আমরা বাইরে হাঁটতে যাই। বাইরে হাঁটতে আমার ভালো লাগে-ইয়ুকা আর আমি একসাথে হাঁটি। হাঁটার সময় আমাদের মধ্যে একটা দড়ি থাকে। আমি অন্য দিকে যেতে থাকলে ইয়ুকা আমাকে টেনে ঠিক পথে নিয়ে আসে।
মাঝে মাঝে আরেকজন আমাদের বাসায় আসে, একজন বড় মানুষ। আম্মু সাথে করে নিয়ে আসে তাকে। সে যখন বাসায় থাকে তখন বাতাস কেমন যেন গুমোট লাগে। যে আরামদায়ক বাসায় আমি আর ইয়কা থাকি সেটা হাওয়ায় মিলিয়ে যায়।
সে যতবারই আসে, সবসময়ই আমার মাথায় হাত বুলায়, আম্মুর দিকে তাকিয়ে হাসে-কিন্তু কখনো সরাসরি আমার চোখের দিকে তাকায় না। আমার মাথায় তার হাতের স্পর্শ পেলেই তাকে আমার কামড়াতে ইচ্ছা করে।
ইয়ুকা আর আমি দু-জনেই তাকে ঘৃণা করি। কারন আম্মু যখন থাকে তখন সে সবসময় ইয়ুকাকে আঘাত করে।
প্রথমবার যখন ব্যাপারটা ঘটল, আমি ভেবেছিলাম আমি হয়তো কল্পনা করছি। আম্মু আমাকে আর ইয়ুকাকে লোকটার সাথে এক রুমে রেখে গিয়েছিল কিচেনে গিয়েছিল।