একটা প্রজাপতির দেহাবশেষ বয়ে নিয়ে যাচ্ছে কিছু পিপড়া। পাথরের ছায়ার ভেতর মনে হচ্ছিল কোন ইয়ট ভেসে যাচ্ছে। মোরিনো একদৃষ্টিতে সেটার দিকে তাকিয়ে আছে।
এই জায়গায় আমাদের দেখা করার পেছনে বিশেষ কোন কারন নেই। হয়তো সুবিধা হত যদি আমরা একসাথে স্কুলের পর বের হতাম। কিন্তু মোরিনো আবার একটু বেশি বিখ্যাত মানুষ। ও যেরকম দেখতে আর ওর যে ভাবভঙ্গি, ওকে নিয়ে সবসময় গুজব ঘুরপাক খায়। ও হেঁটে গেলে লোকজন ঘুরে ওর দিকে তাকায়। আমি চাই না কেউ আমাকে ওর সাথে দেখুক।
মোরিনোর অবশ্য এসব নিয়ে কোন মাথাব্যথা ছিল না। ও সবার সাথেই একই রকম আবেগহীন, অভিব্যক্তিহীন ব্যবহার করত। মনে হত মানুষের যে নার্ভগুলো দুশ্চিন্তা করে, ওর সেগুলো অনেক আগেই কোনভাবে পুড়ে টুরে গিয়েছে বা এরকম কিছু। অথবা এমনও হতে পারে ও হয়তো কখনো খেয়ালও করেনি লোজন ওরদিকে তাকিয়ে থাকে। ও কখনো কখনো এরকম উদাসই থাকে।
“চল,” বলেই হাঁটা শুরু করল ও।
আমিও হাঁটতে লাগলাম ওর সাথে সাথে। ও যেই বইয়ের দোকানে। নিয়মিত যায় সেটা আজকে আমাকে চিনিয়ে দেয়ার কথা।
আমি যখন ওকে দোকানের নাম জিজ্ঞেস করেছিলাম, তখন ও বলেছিল-”খুবই ছোট দোকান, আমি ছাড়া কোন ক্রেতা নাই।” দোকানটা কোথায় হতে পারে তার একটা সাধারণ ধারণা দিয়েছিল আমাকে, কিন্তু কাজ হয়নি। তারপর আমি ওকে বললাম একটা ম্যাপ এঁকে দিতে। ও এমন এক ম্যাপ আঁকল যেটার সাথে এই পৃথিবীর কোন জায়গার কোন মিল পাওয়া গেল না, খুঁজে পাওয়া তো পরের কথা। আরো আঁকাআঁকির পর দোকানটা গিয়ে নদীর মাঝখানে দাঁড়াল। সেটা কিভাবে সম্ভব তার কোন ব্যাখ্যাও দিতে পারল না ও। শেষে আমরা ঠিক করলাম ও নিজেই আমাকে সরাসরি সেখানে নিয়ে যাবে।
আমরা হাঁটতে হাঁটতে দোকান ছাড়িয়ে ঘরবাড়ি ছাড়িয়ে যেতে লাগলাম। সেদিন আকাশ একদম পরিস্কার ছিল, পিঠে সূর্যের তাপ টের পাচ্ছিলাম। রাস্তাটা সোজা চলে গেছে। দুই ধারে মধ্যম আয়ের লোকজনের ঘরবাড়ি সারিসারি দাঁড়ানো। মোরিনোর হাঁটা দেখে মনে হল সে প্রায়ই এই রাস্তা দিয়ে যাওয়া আসা করে।
“তুমি কি কুকুর কিডন্যাপিং সম্পর্কে কিছু শুনেছ?” আমি জিজ্ঞেস করলাম।
“কুকুর কিডন্যাপিং?” সে প্রতিধ্বনি তুলল। কিছু শোনেনি।
আমি ওকে বিস্তারিত জানালাম। আমাদের এলাকা থেকে বেশ কিছুদিন ধরে অনেকগুলো পোষা কুকুর নিখোঁজ হয়েছে। সকালে বাসায় বাবা-মাকে এই নিয়ে আলাপ করতে শুনেছি।
“এইবারই তো প্রথম না,” মা বিড়বিড় করছিল। আমি সবসময় খবরের দিকে নজর রাখি, কোন আজব কিছু ঘটলে মনোযোগ দিয়ে শুনি। কিন্তু এলাকার গুজব-টুজৰ আমার মায়ের চেয়ে ভালো কেউ জানে না।
তার বক্তব্য অনুসারে, সপ্তাহে দুইদিন-বুধবার আর শনিবার সকালে-যেসব লোকজন ঘরের বাইরে তাদের পোষ প্রানীগুলো রাখে তাদের অনেকেরই পোষা প্রাণী নিখোঁজ হচ্ছে। তার মানে সেগুলো মঙ্গলবার আর শুক্রবার চুরি যায়। এখন পর্যন্ত চুরি যাওয়া সবগুলো পোষাপ্রাণীই হচ্ছে কুকুর। যে কারনে লোকজন এখন ভয়ে তাদের কুকুরগুলোকে রাতেরবেলা ঘরের ভেতর রাখছে।
মোরিনো আগ্রহসহকারে আমার কথা শুনল। পুরোটা বলা শেষ হওয়ার পর জিজ্ঞেস করল, “আর কিছু?” আমি মাথা নাড়লাম। ও মনে হল ব্যাপারটা নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করছে।
কুকুর কিডন্যাপিংয়ের ব্যপারে ওর আগ্রহ দেখে একটু অবাকই হলাম। ওর মুখে কখনো কোন পোষা প্রাণীর নাম নিতে শুনিনি। না কুকুর, না বিড়াল, হ্যামস্টার পর্যন্ত না। জন্তু-জানোয়ারের প্রতি ওর কোন মায়া মমতা আছে বলে আমার মনে হয়নি।
“কিডন্যাপার ঐ জিনিসগুলোকে কিডন্যাপ করে কি করে?”
“জিনিস মানে?”
“ঐ যে, ওইসব আর কি, চার পা ওয়ালা নোংরা জিনিস, অনেক চেঁচামেচি করে যে।”
ও কি কুকুর বোঝাতে চাইল?
মোরিনো দূরে তাকিয়ে নিজের মনে বিড়বিড় করল, “আমার মাথায় আসে না কেন কেউ এতগুলো জিনিসকে একসাথে জড়ো করবে? ওগুলো নিয়ে সে কি করতে চায়? কোন ধরনের সৈন্যদল বানানোর ইচ্ছা নাকি? গোলমেলে ব্যাপার।”
ও নিজের মনে কথা বলছিল বলে আমি কোন উত্তর দিলাম না।
“দাঁড়াও,” ও হঠাৎ থেমে গিয়ে বলল।
আমিও থামলাম।
বাঁক নেয়ার আগে তখনো আমাদের সামনে বেশ খানিকটা রাস্তা পড়ে আছে। কী সমস্যা বোঝার জন্য ওর দিকে তাকালাম আমি।
“চুপ,” ঠোঁটে এক আঙুল তুলে বলল সে।
ওর সমস্ত ইন্দ্রিয় এতটাই সজাগ যে, মনে হল যেকোন পরিস্থিতির জন্য তৈরি। আমার মনে হলো ওর কানগুলো মনে হয় কিছু শোনার চেষ্টা করছে।
আমিও শোনার চেষ্টা করলাম, অস্বাভাবিক কোন কিছু কানে ধরা পড়ল না। দূরে কোথাও কুকুর ডাকছে। সাধারণ এক নিস্তব্ধ দুপুর। সূর্যের গরম আলো পিঠে এসে পড়ছিল।
“না আমরা এই দিক দিয়ে আর যেতে পারব না,” অবশেষে ও ঘোষণা দিল।
আমি সামনে তাকালাম। কোন রকম বাঁধা দেখা গেল না, কোন কন্সট্রাক্সনের কাজ চলছে বা কিছু, এমনকি আমাদের পাশ কাটিয়ে এক বুড়ো লোক সাইকেল চালিয়ে চলে গেল।
“বুকস্টোরের জন্য বেশি হয়ে যাচ্ছে। এই রাস্তা দিয়ে…”
আমি ওর কাছে কারন জানতে চাইলাম। কিন্তু স্রেফ মাথা নাড়ল সে। তারপর যেদিক থেকে এসেছিলাম সেদিকেই হাঁটা শুরু করল।
নিজের মনের কথা মত চলার অদ্ভুত এক প্রবণতা আছে মোরিনোর মধে। কে কী ভাবল তাতে ওর কিছুই আসে যায় না। ক্লাসের আর কারো সাথে মেশে না, ওকে নিয়ে কে কী বলল তাতে কান দেয় না। অবসর সময়টা ও একাকি কাটায়, মুখে কোন অভিব্যক্তি ছাড়া। কিন্তু এই মুহূর্তে ওকে বিপর্যস্ত দেখাল…নিশ্চয়ই গুরুত্বপূর্ণ কিছু হয়েছে।