যখন আমি জিতি, ইয়ুকা হাসে। ওকে অনেক খুশি দেখায়। শব্দ দিয়ে হয়তো যোগাযোগ হয় না আমাদের মধ্যে, কিন্তু ওর অনুভূতিগুলো ঠিকই নদীর পানির মত আমার মধ্যে দিয়ে বয়ে যায়। যে কারনে ও খুশি হলে আমি সবসময়ই বুঝতে পারি।
যখন অনেক ছোট ছিলাম তখন থেকেই ইয়ুকা আমার বন্ধু। ওর সাথে। যখন প্রথম দেখা হল তখন আমি আমার মায়ের গা ঘেসে ঘুমাচ্ছিলাম। ইয়ুকা আগ্রহের সাথে আমার দিকে তাকিয়ে ছিল। আমার এখনো স্পষ্ট মনে আছে সেদিনের কথা।
আমার হুংকারের অর্ধেকটা রাতের আকাশে মিলিয়ে গেল। বাকি অর্ধেক ব্রিজের নিচে প্রতিধ্বনি তুলতে লাগল। উপরের দিকে তাকিয়ে আমি খালি রাতের কালি ঘোলা আকাশ ছাড়া আর কিছুই দেখতে পেলাম না।
নদীটা বেশ চওড়া ছিল। ব্রিজটাও বিশাল। নদীর তীরে ব্রিজের আশেপাশে লম্বা লম্বা ঘাসের সমুদ। কোথাও যেতে হলে সেগুলো ঠেলে যেতে হয়। কিন্তু ব্রিজের নিচে জায়গাটা খোলা, গোলাকৃতির, কোন ঘাস নেই। কারন সূর্যের আলো সেখানে পৌঁছতে পারে না। আমরা এখন দাঁড়িয়ে আছি এখানে।
গ্রীষ্মের একদিনে আমি আর ইয়ুকা জায়গাটা খুঁজে পেয়েছিলাম। খোলা একটা জায়গা, চারপাশে লম্বা ঘাসের দেয়াল। সেই থেকে জায়গাটা আমাদের খেলার গোপন জায়গা।
কিন্তু এখন এখানে ইয়ুকা আমাকে লড়াই করতে বলে।
আমি কোন প্রাণীকে আঘাত করতে কিংবা খুন করতে চাই না, কিন্তু ইয়কা চায় আমি করি। ও যখন আমাকে আদেশ দেয় তখন ওর চোখগুলো রাতের মত গাঢ় হয়ে যায়, সেখানে কোন আলো থাকে না।
ইয়কা গোলাকৃতি জায়গাটার কোণায় বসে এতক্ষন ধরে সবকিছু দেখছিল। এখন সে উঠে দাঁড়াল। বাড়ি ফেরার সময় হয়েছে। ও কি ভাবছে আমি বুঝতে পারছিলাম। আমাদের মধ্যে অন্যরকম একটা যোগাযোগ রয়েছে যা কিনা সকল ভাষার বাইরে।
মৃতদেহটা তুলে নিয়ে ভোলা জায়গাটার বাইরে একটা গর্তে ফেললাম আমি। ছোট শরীরটা গড়াতে গড়াতে নিচে নেমে গেল। গর্তটা তেমন গভীর না কিন্তু তলাটা ছিল অন্ধকার, উপর থেকে কিছু দেখা যাচ্ছিল না। লাশটা নিচে পড়ার শব্দ কানে ভেসে এল।
জায়গাটা যখন আমরা খুঁজে পেয়েছি তখন থেকেই গর্তটা এখানে ছিল। কেউ হয়তো কোন কারনে খুঁড়েছিল, হয়তো কোন কিছু পুঁতে রাখার জন্য। অন্ধকারের কারনে কিছু দেখা না গেলেও গর্তটা এখন মৃত জন্তুর লাশে পূর্ণ, যেগুলোকে খুন করতে আমাকে বাধ্য করেছে ইয়ুকা! গর্তের কাছাকাছি গেলে জঘন্য দুর্গন্ধ নাকে এসে বাড়ি মারে।
প্রথমবার যখন ব্রিজের নিচে আমরা এরকম কাজ করেছিল, ইয়ুকা আমাকে আদেশ করেছিল লাশ নিয়ে গর্তে ফেলতে। তখন আমি ঠিকমত লড়তে জানতাম না, প্রতিপক্ষের মতই বেশ আঘাত পেয়েছিলাম। প্রতিপক্ষের মুখোমুখি হয়ে মাথার ভেতরটা শূন্য হয়ে গিয়েছিল, বুঝতে পারছিলাম না কি করব। কিন্তু এখন আমি লড়াইয়ে দক্ষ হয়ে উঠেছি। শান্তভাবে এখন আমার প্রতিপক্ষের জান কবচ করতে পারি। আমাকে দক্ষ হয়ে উঠতে দেখে ইয়ুকাও খুশি।
কামড়াকামড়ির সময় প্রতিপক্ষের শরীরের নোম আমার মুখে রয়ে গিয়েছিল। আমি সেটা গিলে ফেলে ঘাস ঠেলে পানির দিকে এগুলাম। পানির রং কালো দেখাচ্ছে। মনে হচ্ছে নদী নয় বরং অন্ধকার ভেসে যাচ্ছে। ব্রিজের আলো অপর পাড়ের পানিতে আলো ফেলছিল।
পানি দিয়ে মুখে লেগে থাকা রক্ত ধুয়ে নিয়ে ইয়ুকার কাছে ফিরে গেলাম।
“যাওয়ার সময় হয়েছে,” ইয়ুকা সিঁড়ির দিকে এগুতে এগুতে এরকম কিছু একটাই বলল।
সিঁড়িটা আড়াআড়িভাবে ব্রিজের দিকে উঠে গিয়েছে। খোলা জায়গাটা থেকে সিঁড়ির কাছে যেতে লম্বা ঘাসগুলো ঠেলে সরিয়ে যেতে হয়। আমি দৌড়ে ওর পাশে গেলাম। আমরা একসাথে হাটি।
সিঁড়ির কাছাকাছি পৌঁছুতেই আমার মনে হল কিছু ঘাস নড়তে দেখলাম-ঘাসের মাথা হালকা দুলছে। এক মুহূর্তের জন্য আমার মনে হল কেউ ওখানে দাঁড়িয়ে আছে। চিন্তিত হয়ে উঠলাম। ভালো করে কান পেতে শুনলাম। কিন্তু না। মনে হয় বাতাসের জন্য।
ইয়ুকা ততক্ষণে সিঁড়ি বেয়ে উপরে পৌঁছে আমার জন্য অপেক্ষা করছিল। দৌড়ে সিঁড়ি বেয়ে উঠে ওর কাছে গেলাম, আমাদের গোপন জায়গাটা পেছনে পড়ে রইল।
***
স্কুলের পর স্টেশনের সামনে গিয়ে আমার ক্লাসমেট মোরিনোর সাথে দেখা করলাম। টারমিনালের কাছে একটা বড় বাস দাঁড়ানো। পাশেই ফোয়ারা আর কিছু ফুল গাছ। কয়েকটা বেঞ্চও আছে, কিছু লোকজন সেখানে বসে অলস সময় ব্যয় করছিল।
মোরিনো ঐ বেঞ্চগুলোর একটায় বসে ছিল। রাস্তা থেকে সবচেয়ে দূরে ছিল যেটা, সেটা গাছপালার ছায়ায় ঢাকা। হাতে সময় থাকলেই ও বই নিয়ে বসে থাকে। আজকে অবশ্য কোন বই পড়ছে না। বইটা বন্ধ করে পাশে রাখা।
মোরিনো সামনের দিকে ঝুঁকে আছে। মাথা নামানো। ঘন কালো চুলগুলোর পেছনে ওর চেহারা ঢাকা পড়ে গেছে, পর্দার মত।
কাছাকাছি যেতেই ও মুখ তুলে আমার দিকে তাকাল। ওর ত্বক পোরসেলিনের মত ফ্যাকাসে সাদা, যেন কোনদিন সূর্যের আলো পড়েনি। বাম চোখের নিচে ছোট্ট একটা তিল। ওর অঙ্গভঙ্গি পুতুলের মত, মনে হয় যেন কোন জীবন নেই। নড়াচড়া না করলে দোকানে রাখা ম্যানিকুইন বলে চালিয়ে দেয়া যাবে ওকে।
ও চুপচাপ নিচের দিকে ইশারা করল। ওর পায়ে কিছু কাদা লেগে ছিল। ভালো করে তাকাতে মনে হল কিছু একটা নড়ছে।