জানালা দিয়ে আসা আলোতে স্টেইনলেস স্টিলের সিঙ্ক একদম চকচক করছিল। একমাত্র শব্দ যেটা কানে আসছিল তা হল রেফ্রিজারেটর থেকে আসা গুনগুন শব্দ। নয়তো চারদিকে একদম কেমিস্ট্রি লেকচার হলের মত নিরবতা বিরাজ করছে। আমার সে রকমই অনুভূতি হচ্ছিল।
কিচেনের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আমি আবার আমার পালস পরীক্ষা করলাম। কব্জির চামড়ার নিচে রক্তের শিরাগুলো অবিচল রক্ত বহন করছে। পালস এখন স্বাভাবিক। তারপর আবার হঠাৎ দ্রুত হয়ে গেল, যেন যে কোন সময় ফেটে যাবে।
নাকে একটা বাজে গন্ধ আসছিল। মনে হচ্ছে কোন কিছুতে পচন ধরেছে, ব্যাকটেরিয়া আক্রমণ করেছে। গন্ধটা পেয়েই আমার হৃদস্পন্দন বেড়ে গেল।
গন্ধটা কোত্থেকে আসছে তা খুঁজতে লাগলাম। কাপ বোর্ড কিংবা ড্রয়ারে কিছু ছিল না। রেফ্রিজারেটরের উপর দৃষ্টি গিয়ে স্থির হল আমার।
হাতের ছাপ যেন না পড়ে সেজন্য রুমাল দিয়ে রেফ্রিজারেটরের হাতল ধরে টানলাম। বাজে গন্ধটা বেড়ে গেল। আমার অনুমানই সঠিক-মি, সিনোহারাই কাটা হাতের অধি।
ফ্রিজের আলোতে দেখা গেল ভেতরে সেলফের উপর সারি সারি কাটা হাত। আঙুল আর নখ সমান করে সেগুলো পিয়ানোর কি-এর মত করে পাশাপাশি সাজিয়ে রাখা হয়েছে। পেছন দিকে কিছু ছোট বাটিতে ককর আর বিড়ালের সামনের পায়ের থাবাগুলো রাখা। লেকচার হলের ময়লার ঝুড়িতে পাওয়া পুতুলের হাতগুলো ফ্রিজের দরজায় খুঁজে পেলাম। ওগুলো দেখে মনে হচ্ছিল কাপড়ের বল, কিন্তু রং পুতুলের মত হওয়ায় চিনতে অসুবিধা হয়নি।
অনেক আগে থেকেই আমার ধারণা ছিল অপরাধি নিশ্চয়ই হাতগুলো সংরক্ষন করছে। এই ধারনার পেছনে কোন ভিত্তি না থাকলেও আমার মনে হয়েছিল, কারন আমি হলেও একই কাজ করতাম। আর দেখা গেল আমার ধারনাই সঠিক।
একটা হাত তুলে নিলাম, একজন নারীর হাত। হাতের লাল নেইলপলিশ জায়গায় জায়গায় উঠে গিয়েছিল, আর ঠান্ডায় জমে বেশ ভারিও লাগছিল হাতটাকে।
মৃত ত্বকের স্পর্শ…না ঠিক মৃত বলা যাবে না, সব ভিক্টিমই বহাল তবিয়তে বেঁচে আছে, শুধু তাদের হাতগুলো নেই…কিন্তু এটাও ঠিক যে তাদের কাটা হাত তো মৃতই..
ওখানে ডান-বাম সব রকমের হাতই ছিল। কিছু হাতের নখ কালো হয়ে গেছে। কিছু হাতের ত্বক তখনো সুন্দর মসৃণ।
হাতগুলোর উপর নিজের হাত বোলালাম। মনে হচ্ছিল আমি যেন মি. সিনোহারার ভেতরটা ফুটো করে দেখতে পাচ্ছি। সাধারন মানুষ বিষয়টা বুঝতে পারবে না, আমি নিশ্চিত মি. সিনোহারা নিজেও জানেন কেউ যে তাকে বুঝতে পারবে না। কিন্তু আমার জন্য কল্পনা করা সহজ ছিল, তিনি একা এই কিচেনে দাঁড়িয়ে তার হাতের সংগ্রহের উপর হাত বোলাচ্ছেন।
হাতগুলো যেহেতু তার রেফ্রিজারেটরে রাখা, তিনিই হাত কাটার অপরাধি। পুলিশকে খবরটা জানানোর কোন ইচ্ছা আমার নেই। হয়তো আমার উচিত তাদের জানানো, কিন্তু সেরকম কোন আগ্রহ আমার ছিল না। বরং আমার অন্য একটা পরিকল্পনা ছিল।
আমি নিজেও কারো হাত কাটতে চাইছিলাম। মি. সিনোহারার সংগ্রহ দেখার পর ইচ্ছেটা এখন আরো বেড়ে গেল।
ফ্রিজের ভেতর তাকালাম। কত ধরনের হাত সেখানে রাখা। যে কোনটা আমি নিতে পারতাম, কিন্তু যে কোন একটা নিলেই হবে না, বিশেষ একজনের হাত আমি চাই। সাথে আনা ব্যাগে হাতগুলো সব ভরে নিলাম।
***
স্কুলের কাজ শেষে সিনোহারা যখন বাসায় ফিরল তখন সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছে। বাসায় ঢুকে লিভিং রুমের দিকে যেতে গিয়ে সে টের পেল কিছু একটা ঠিক নেই। জানালাটা ভাঙা। মেঝেতে কাঁচের গুঁড়ো পড়ে আছে। জানালাটা খোলা থাকায় ঘরের ভেতর ঠান্ডা বাতাস ঢুকছিল। কেউ একজন চুরি করে ওর বাসায় ঢুকেছে!
প্রথম যে জিনিসটা সিনোহারার মাথায় এল তা হল রেফ্রিজারেটরের ভেতর রাখা হাতগুলো। সোজা কিচেনে গিয়ে রেফ্রিজারেটর খুলল। নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিল না। সব হাত উধাও। সেদিন সকালেও সে সব হাত সেখানে দেখে গিয়েছে। মানুষের হাত, পুতুলের হাত, পশুর থাবা সব উধাও! ফ্রিজ একদম খালি। শুধু হাতের সাথে রাখা অল্প কিছু খাবার পড়ে ছিল।
কিছু একটা ওকে খোঁচাচ্ছিল, কিন্তু বুঝতে পারছিল না সেটা কি। লিভিং রুমের কাঁচের টুকরাগুলো পরিস্কার করা দরকার। হাত হারানোর শোকে ওর মাথা তখন ঠিকমত কাজ করছিল না।
দোতলায় গিয়ে কম্পিউটার অন করে সামনে বসল।
কেউ একজন জানালা ভেঙে ঢুকে সব হাত চুরি করে নিয়ে গেছে, সবগুলো হাত।
এক ফোঁটা পানি কম্পিউটারের ডেস্কের উপর পড়ল। সিনোহারা হঠাৎ উপলদ্ধি করল সে কাঁদছে।
তার পুরো জীবনে সে কখনো কোন মানুষের সাথে এতটা অন্তরঙ্গ হতে পারেনি যতটা এই হাতগুলোর সাথে হয়েছিল। কেউ যদি তাকে হাতগুলোর সাথে দেখত তাহলে মনে করত সে সেফ চুপচাপ বসে আছে, কিন্তু না, সিনোহারা আসলে ঐ ঠান্ডা নির্বাক হাতগুলোর সাথে কথোপকথন করত, ওগুলোকে স্পর্শ করার মাধ্যমে।
সারা শরীর জুড়ে এমনভাবে ক্রোধের ঢেউ উঠে এল যে সিনোহারার নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল। পুলিশকে এই চুরির খবর জানানো সম্ভব নয়। কিন্তু হাতগুলো যে-ই নিয়ে থাক সিনোহারা অবশ্যই তার বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেবে।
সে কখনো কাউকে খুন করেনি, কিন্তু এবার এর ব্যতিক্রম ঘটবে। যেভাবেই হোক সে এই চোরকে ধরবেই। ওর হাতগুলোও সে কেটে নেবে, তারপর গলা টিপে মারবে। কিংবা বুকে ছুরি বসিয়ে দেবে।