টিচারের নির্দেশমত আমি সেলফের উপর থেকে বাক্সগুলো নামিয়ে বোতলের ভেতরের কেমিক্যালগুলো পরীক্ষা করে দেখছিলাম।
অন্যদিকে তিনি কমেপ্রসড বাতাসের একটা ক্যান নিয়ে কম্পিউটারের কিবোর্ডের ধুলো পরিস্কার করছিলেন-লোকটা বেশ খুঁতখুঁতে।
ঝাড়পোঁছের পুরোটা সময় তিনি আমার পাশে দাঁড়িয়ে কাজ করছিলেন, ময়লার ঝুড়িতে উঁকি দেয়ার সুযোগ ছিল না।
কাজ শেষ হলে আমরা একগাদা ময়লা টেনে লেকচার হলে নিয়ে গেলাম।
“আজকাল এরকম লম্বা কালো চুলের মেয়ে দেখাই যায় না, সবাই এখন চুল রং করে,” মোরিনোর দিকে তাকিয়ে টিচার বললেন। মেয়েটার চুলগুলো আসলেই ঘন কালো আর খুবই সুন্দর ছিল। আমি তাকে বললাম যে আমার বোনের চুলও প্রায় একইরকম।
মোরিনো ওর শুকনো ফ্যাকাসে সাদা হাত দিয়ে বইয়ের পাতা উল্টাচ্ছিল। এত ফ্যাকাসে যে লেকচার হলের হালকা আলোতে মনে হচ্ছিল ওর হাতগুলো রীতিমত জ্বলজ্বল করছিল। দৃশ্যটা এখনো আমার চোখে
টিচার আর আমি আবর্জনাগুলো নিয়ে ইন্সিনারেটরে পুড়িয়ে ফেললাম। তারপর যে যার দিকে চলে গেলাম। আমি তাড়াতাড়ি লেকচার হলে ফিরে আসলাম। দুপুরের ক্লাস শুরু হওয়ার আগে মাত্র দশ মিনিট বাকি ছিল আমার হাতে।
হলে ঢুকে দেখি ততক্ষণে মোরিনো চলে গিয়েছে, সম্ভবত ক্লাসেই গিয়েছে। যাক ভালই হল আমার জন্য।
ডেস্কের নিচে লুকানো ময়লার ঝুড়িটা বের করে আমি ভেতরে হাতরালাম কি আছে দেখার জন্য। সাথে দরজার দিকে একটা চোখ রেখেছিলাম কেউ আসে কিনা দেখার জন্য। দুর্ভাগ্যজনকভাবে যা খুঁজছিলাম সেরকম কিছু ছিল না।
বরং অদ্ভুত একটা জিনিস পেলাম সেখানে। যত্নের সাথে কাগজের পর কাগজ দিয়ে মুড়িয়ে রাখা কিছু একটা। কাগজগুলো সরিয়ে আমি একটা পুতুল পেলাম, কবজি থেকে হাতগুলো কাটা।
ছোট পুতুলটা কাপড়ের তৈরি ছিল। এত ছোট যে হাতের তালুতে এঁটে যায়। পায়ের কোন ক্ষতি হয়নি। ডিজাইন দেখে যা মনে হচ্ছিল তা হল কাটা হাতগুলোতে কোন আঙুল ছিল না। একদম সাধারন ধরনের একটা পুতুল। কিন্তু জিনিসটা আমাকে যা মনে করিয়ে দিল তা হল টিভিতে দেখা কাটা হাতের কেস।
বিভিন্ন বয়সের শিশু-বুড়ো-নারী-পুরুষকে, যখন তারা রাস্তায় একা হাঁটে, কেউ একজন তাদের অজ্ঞান করে হাতগুলো কেটে নেয়। এমন কি কুকুর-বিড়ালদেরও সামনে থাবা কাটা অবস্থায় পাওয়া গিয়েছিল। খবরে বলা হচ্ছিল দুটোই একই লোকের কাজ। ঘটনাগুলো এখান থেকে খুব
একটা দূরে ঘটেনি।
কেমিস্ট্রি টিচার, মি. সিনোহারা কি পুতুলের হাতগুলো কেটেছেন? কোন রকম খেলা নাকি? না, আমার বিশ্বাস তিনিই এই কাটা হাতের ঘটনাগুলোর পেছনের লোক। যদিও হাত কাটা একটা পুতুল পাওয়া থেকে খুব বেশি অনুমান করা হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু যে হাতগুলো সে কেটেছে সেগুলো ধারে কাছেই কোথাও রেখেছে বলে আমার মনে হয়। আর আমি চিন্তা করলাম, কেন কেমিস্ট্রি টিচার পুতুলের হাতগুলো কাটতে পারেন
মনে হচ্ছিল তা উড়িয়ে দেয়ার সম্ভাবনা কম। আমার ধারণা ব্যাপারটা স্রেফ তার উদ্যম শক্তির একটা অংশ।
***
হাতকাটা পুতুলটা পাওয়ার পর থেকে প্রতিদিনই আমি ক্লাসে বসে কাটা হাতের কেসটা নিয়ে চিন্তা করি। মিডটার্ম সামনেই, কিন্তু সেদিকে আমার কোন খেয়াল ছিল না। টিভিতে যেসব ভয়াবহ খবর দেখায়, তার মধ্যে এটা সবচেয়ে আকর্ষণীয় ছিল। কালপ্রিটের মত একই কাজ আমিও করতে চাইতাম। আর আমার বিশ্বাস…ঐ মানুষটা ঠিক আমারই মত। কিছু তো পার্থক্য আছেই, কিন্তু তারপরেও কাটা হাতের এই অপরাধির সাথে কোথাও আমার নিজের একটা মিল টের পাচ্ছিলাম।
সেদিনের পর থেকে আমি প্রায়ই ক্লাসের মাঝের বিরতিতে লেকচার হলের সামনে যোরাঘুরি করতাম যাতে মি. সিনোহারার সাথে দেখা হয়। আমাকে তার মনে ছিল, দেখা হলে হাত নাড়তেন। অল্পবয়সি একজন যুবক, শুকনো ধরনের, মাথায় ছোট ছোট চুল। আমি অনেকবার চিন্তা করেছি কাটা হাতের রহস্যের পেছনে আসলেই এই লোকটা আছে কিনা।
একবার দেখলাম মি. সিনোহারা লেকচার হলের বাইরে মোরিনোর সাথে কথা বলছেন। মোরিনোর হাতে একটা বই দেখে তিনি বলছিলেন তার সংগ্রহে বইটার পরবর্তি খন্ড আছে। মানসিক ভারসাম্যহীনতার উপর লেখা একটা নন-ফিকশন বই। উত্তরে মোরিনো শুধু বলেছিল “তাই নাকি?” বরাবরের মত ওর চেহারায় কোন অভিব্যক্তি ছিল না।
ক্লাসে আমি আমার ভন্ডামি চালিয়ে যেতে লাগলাম। সাধারণ একজন হাইস্কুল কিশোর হিসেবে অভিনয় করা, লোকজনের চোখে না পড়া-আমার জন্য সহজ কাজ ছিল। কিন্তু মাথায় সারাক্ষণ কাটা হাতের কেস সংক্রান্ত ব্যাপার স্যাপার ঘুরত। এরকম ইন্টারেস্টিং একটা বিষয় বাদ দিয়ে সবার সাথে হাসি খুশি চেহারা করে তারকাদের গুজব নিয়ে কথা বলা বেশ ক্লান্তিদায়ক ছিল। মাঝে মাঝে নিজেকে অপদার্থ মনে হত এত শ্ৰম ক্ষয় করার জন্য।
দেখা গেল মি. সিনোহারা যেমন বলেছিলেন, মোরিনো আসলেই লেকচার হলে বেশ ভালো সময় কাটায়। যতবার আমি সেখানে উঁকি দিয়েছি, দেখেছি অন্ধকার রুমে সে চুপচাপ বসে আছে।
ও সবসময় একা থাকত। এমন না যে, ওর সাথে কেউ ঝামেলা করত, কিংবা কোনো ধরনের হেনস্তা করত ওকে। ব্যাপারটা এরকম যে ও ইচ্ছা। করেই সবার সাথে সবরকমের দূরত্ব বজায় রাখার চেষ্টা করত। ওর পাথরের মত কঠিন নিরবতা দেখলে বোঝা যেত আর দশটা ছেলে মেয়ের আগ্রহের সাথে ওর আগ্রহের বিষয়ের কোনই মিল নেই।