এরপর থেকে আমি মিথ্যা কথা বলায় পারদর্শি হয়ে উঠলাম। যেমন ধরা যাক, আঁকাআঁকি করার ক্রেয়নের ক্ষেত্রে। কালো ক্রেয়নটা অন্যগুলোর চেয়ে ছোট ছিল, আমি সাবধানতার সাথে বাকি রংগুলোও ছোট করে এক সমানে নিয়ে আসতাম। আঁকাআঁকিতে আমার তেমন একটা আগ্রহ ছিল না, কিন্তু আঁকলে রংধনু, ফুল এইসব হয়তো আঁকতাম। আশেপাশের বড়রা এগুলো দেখে স্বস্তিবোধ করত।
দুনিয়া কী চায় তা একবার ধরে ফেলায় আমার জন্য সহজ ছিল অন্যদেরকে বোঝানো যে আমার কোন সমস্যা নেই। আমি আমার ক্লাসমেটদের ফালতু গল্পের মধ্যে নিজে থেকে গিয়ে যোগ দিতাম।
ঐদিন যে আমি কেমিস্ট্রি অফিসে সাহায্য করতে গিয়েছিলাম তা আমার ক্লাসমেটদের বলিনি। ক্লাসে আমি যার চরিত্রে অভিনয় করি সে এরকম কিছু করবে না। ওরা ভাবতে পারে, গ্রেড বাড়ানোর জন্য এরকম কাজ করছি। আমি সেটা এড়াতে চেয়েছিলাম। তাছাড়া উদার মনে আমি কাজটা করিনি, আমার একটা উদ্দেশ্য ছিল।
গুজব শুনেছি যে আমাদের কেমিস্ট্রি টিচার তার কেমিস্ট্রি অফিসের ডেস্কে বসে পরীক্ষার প্রশ্ন তৈরি করেন। এমন হতে পারে আবর্জনার ঝুড়িতে তার নোটগুলো পাওয়া যেতে পারে। আমি সেগুলো হাতে পেতে চাইছিলাম।
প্রথম বর্ষ থেকেই আমি মাঝে মধ্যে এই টিচারকে অফিস পরিস্কারে সাহায্য করে আসছি। তাই আমার জানা আছে তিনি কিভাবে কাজ শুরু করেন-প্রথমে আমাকে বলবেন ময়লাগুলো নিয়ে পাশের লেকচার হলে রেখে আসতে। তারপর আমরা একসাথে অফিস গোছাব। এরপর আবার ময়লা সরানোর সময় তিনিও আমার সাথে হাত লাগাবেন (যে পরিমান আবর্জনা বের হয় তা বহন করতে দু-জনকে লাগে)। গত বছর অন্তত এমনই হয়েছিল।
তো এখানে সমস্যাটা হলো-ময়লার ঝুড়ি থেকে কাগজগুলো তুলে নেয়ার সময় নেই। তাই আমার একটা প্ল্যানের দরকার ছিল। প্রথমে অন্য ক্লাসরুম থেকে আমি আরেকটা ময়লার ঝুড়ি এনে কেমিস্ট্রি লেকচার হলে লুকিয়ে রাখলাম। তারপর কেমিস্ট্রি অফিসে গিয়ে টিচারকে সাহায্য করতে চাইলাম।
যদি সবকিছু গত বছরের মতই হয় তাহলে প্রথমে আমাকে ময়লার ঝুড়ি লেকচার হলে বহন করে নিয়ে যেতে হবে। যদি তা না হয় তাহলে কোন এক সময় তার দৃষ্টির আড়ালে আমাকে তা করতে হবে। স্কুলের সব ময়লার ঝুড়ি দেখতে একই রকম, সবগুলোই নীল রঙের। যে কারনে আমার লুকিয়ে রাখা ময়লার ঝুরির সাথে কেমিস্ট্রি অফিসের ময়লার ঝুড়ি গোপনে বদলে ফেলা যাবে।
আমাদের কাজ শেষ হলে সব ময়লা একসাথে নিয়ে টিচারের চোখের সামনে আগুনে পুড়িয়ে ফেলা হবে। কিন্তু পরীক্ষার নোট ওয়ালা ঝুড়ি কেমিস্ট্রি হলের ডেস্কের তলায় লুকানো থাকবে। পরে আমি সুযোগ মত সেখান থেকে নোটগুলো সরিয়ে নেব।
আগে যেরকম বলেছি, অফিসে ঢোকার আগেই অন্য ক্লাস রুম থেকে একটা ময়লার ঝুড়ি এনে লেকচার হলে লুকিয়ে রেখেছিলাম। যে রকম আশা করেছিলাম সেরকমই হলো, আগের বছরের মত এবারও টিচার আমাকে অফিসের ময়লার ঝুড়ি নিয়ে লেকচার হলে রাখতে বললেন। সবকিছু মসৃণভাবেই চলছিল।
আমার প্ল্যান যেন উনি টের না পান সেজন্য যতটা সম্ভব তার নির্দেশ মতই সব কাজ করছিলাম। লেকচার হল আর কেমিস্ট্রি অফিসের মধ্যেই একটা দরজা ছিল, আলাদা করে বাইরে থেকে ঘুরে ঢুকতে হত না।
এমন সময় প্ল্যানের বাইরে একটা ঘটনা ঘটল। একটু আগে লেকচার হল খালিই ছিল, কিন্তু আমি যখন ময়লা নিয়ে সেখানে গেলাম তখন দেখি রুমের এক কোণায় বসে একটা মেয়ে বই পড়ছে। মেয়েটার চুল লম্বা ঘন কালো। লেকচার হলের হালকা আলোতে তাকে ভুতুড়ে কোন ছায়ার মত লাগছিল দেখতে। ভালো করে তাকিয়ে মেয়েটাকে চিনতে পারলাম। মেয়েটার নাম মোরিনো, বসন্তের টার্মের শুরু থেকে আমার ক্লাসেই পড়ছে।
মুখ তুলে আমাকে দেখে আবার বইয়ে মনোযোগ দিল সে। দরজা থেকে সবচেয়ে দূরের ডেস্কটায় বসে ছিল। আমি কি করছি না করছি সে ব্যাপারে ওর কোন আগ্রহ ছিল না।
প্রথমে ভেবেছিলাম, সে-ও বোধহয় সাহায্য করতে এসেছে, কিন্তু না। আমার কেন যেন মনে হলো ও আমার প্ল্যানে কোন বাগড়া দেবে না।
মোরিনোর সাথে আমার কখনো কথা হয়নি ঠিকই, কিন্তু ওর অস্বাভাবিকতা আমার চোখে পড়েছে। সে কারো সাথে মিশত না। না মেশার কারনে বরং আরো বেশি বেশি সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করত। ক্লাসে কিছু ছেলেমেয়ে ছিল যারা কিনা হাসিখুশি, প্রাণশক্তিতে ভরপুর। মোরিনো তাদের উল্টোপথে চলার সর্বাত্মক চেষ্টা চালাত। কেউ তার সাথে কথা বলতে আসলে সে না শোনার ভান করত। একা থাকতে চাইত। একা থাকতে ভালবাসত ও।
আর এখন সে লেকচার হলের কোনায় বসে বই পড়ছে। আমি ওকে উপেক্ষা করলাম। চুপচাপ লুকানো ময়লার ঝুড়ির সাথে অফিসের ঝুড়ি বদলে ফেললাম। মনে হল না মোরিনো কিছু খেয়াল করেছে।
তারপর অফিসে ফিরে এলাম, ভাবটা এমন যেন কিছুই হয়নি।
“ওখানে একটা মেয়ে বসে আছে না? প্রতিদিন লাঞ্চের সময় সে এসে ওখানে বসে থাকে,” কেমিস্ট্রি টিচার বললেন। লেকচার হলটা ছিল স্কুলের সবচেয়ে নিস্তব্ধ স্থান। আলোও কম ছিল সেখানে। আমি বুঝতে পারছিলাম কেন মোরিনো সেখানে যায়। জায়গাটার সাথে আমাদের ক্লাসরুমগুলোর একদমই কোন মিল নেই। জায়গাটা এত চুপচাপ যে মনে হত সময় এসে ওখানে থেমে গিয়েছে। জায়গাটার মধ্যে কেমন জানি একটা অস্বাভাবিকতা ছিল, অনেকটা লাশ কাটা ঘরের মত।