সিনোহারা কাউকে খুন করেনি। সে সবসময় শুধু ওদের হাতগুলো চাইত, কাউকে খুন করতে চাইত না। অবশ্য হাত ছাড়া বাকি অংশ বাঁচল কি বাঁচল না তাতে ওর কিছু এসে যেত না। ওকে কেউ দেখে না ফেললেই হলো। হাত কেটে নিয়ে সংজ্ঞাহীন দেহগুলো স্রেফ ফেলে রেখে ও চলে আসত।
খবরের কাগজ আর টিভি চ্যানেলগুলো জানিয়েছিল, হাসপাতালে জ্ঞান ফিরে পাওয়া একজন ভিক্টিমও আক্রমণকারীর চেহারা দেখেনি। ব্যাপারটা সিনোহারার জন্য স্বস্তিদায়ক ছিল। যদিও আঁধারের মধ্যে গোপনে কাজ সারত ও, কিন্তু ধরা পড়ে যায় কিনা এই নিয়ে সবসময়ই ভয়ে ভয়ে থাকত।
সিনোহারা হাত ভালবাসত। ওগুলো কেটে আলাদা করতেও ওর ভালো লাগত। শরীরের বাকি অংশ থেকে হাতগুলোকে আলাদা করার পর ওর অন্যরকম একটা নিশ্চিন্ত বোধ হতো। ওর মতে, হাত আলাদা করার ব্যাপারটা আসলেই বেশ সাহসী, নায়কোচিত একটা কাজ ছিল।
এমন কি ওর কর্মক্ষেত্রেও একটা পুতুলের হাত কেটে নিয়েছিল ও। একটা ছোট সস্তা তুলোর পুতুল। ছোট হওয়ার কারনে পুতুল্টার হাত নিখুঁতভাবে বানানো হয়নি-কোন আঙুল ছিল না, হাতের শেষ ভাগ ছিল মসৃণ, গোলাকার। কারখানায় বানানো পুতুলের হাতের বিকাশ এভাবেই হয়েছিল, আঙুল ছাড়া। ওগুলো কেটে সিনোহারা ওর আর দুনিয়ার মধ্যে তৈরি হওয়া টেনশনের চাপ কমাত। তারপর সবগুলো কাটা হাত নিয়ে রেফ্রিজারেটরের ভেতর সাজিয়ে রাখত। সেটা কাপড়ের পুতুলের হাত হোক আর বিড়াল কুকুরের থাবা হোক, কখনো সেগুলো ফেলত না।
সিনোহারা একাকি বসবাস করত, কিন্তু ওর বাসাই ওর জীবন ছিল। বাসায় গিয়ে ফ্রিজ খুলে সাজিয়ে রাখা হাতগুলো দেখত। যখন সেগুলো
স্পর্শ করত, ওর মনে হত সে ওগুলোর মালিকের অতীত দেখতে পাচ্ছে, তাদের ভবিষ্যৎ দেখতে পাচ্ছে, তাদের জীবনের সব ঘটনা যেন হাতগুলোর মধ্যে জমাট হয়ে আছে। ওগুলো স্পর্শ করার মাধ্যমে ও হাতগুলোর সাথে কথা বলত। হাতগুলো তাকে বলত তাদের মালিকেরা তাদের ব্যবহার করে কী করে প্রেম করেছে, কিভাবে অন্যকে কষ্ট দিয়েছে-সবকিছু।
খবরের কাগজ আর টিভি চ্যানেলগুলো প্রতিদিন সিনোহারার কৃতকর্ম নিয়ে কথা বলত। তারা এটাকে নাম দিয়েছিল-’কাটা হাতের কেস’। নামে সিনোহারার কিছু এসে যেত না। কিন্তু সবাই ওকে ঘৃণা করছে, ওকে একজন অপরাধি হিসেবে দেখছে, এই ব্যাপারটা ওর কাছে ভালো লাগছিল না। সমাজের ভালো খারাপের সংজ্ঞা ওর উপর জোর করে চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে, যেটা ওর পছন্দ না।
সন্ধ্যার খবর দেখতে দেখতে সিনোহারা ব্যাপারটা নিয়ে একটা বাচ্চার হাতের সাথে কথা বলল। হাতটা ও রেফ্রিজারেটর থেকে বের করে নিজের হাতে ধরে রেখেছে।
“তুমি একদম ঠিক কথাই বলেছ,” হাতটার ভাঁজ, পেশি, আঙুলগুলো যেন ওর কথা শুনে এটাই বলল।
অমনি সিনোহারার রাগ, দুশ্চিন্তা পানি হয়ে গেল। ও টের পেল ভেতর থেকে আবার সাহস মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে।
২
সকালের ক্লাসে কেমিস্ট্রির টিচার বললেন, “লাঞ্চের সময়ে আমি কেমিস্ট্রি অফিস গোছগাছ করব। কারো হাতে যদি সময় থাকে, আমাকে এসে সাহায্য করলে খুশি হব।”
টিচারের চেহারা দেখে মনে হচ্ছিল না উনি আসলে আশা করছিলেন যে কেউ সত্যি সত্যি এসে তাকে গোছগাছের কাজে সাহায্য করবে। আসলেও বেশিরভাগ ছাত্রছাত্রি উনার কথা কানেই তোলেনি। সুতরাং আমি যখন লাঞ্চের সময় উনার অফিসে গিয়ে হাজির হলাম, তখন স্বাভাবিকভাবেই উনি বেশ অবাক হলেন।
দিনটা ছিল চমৎকার, মনে হচ্ছিল যেন বসন্তের উষ্ণ আলো জানালার বাইরে গলে গলে পড়ছে। কিন্তু কেমিস্ট্রি অফিসের ভেতরটা ছিল বেশ অন্ধকার, আর খানিকটা ঠান্ডা। বাইরে থেকে আসা ছাত্রছাত্রিদের খেলাধুলা আর হাসাহাসির শব্দ পাচ্ছিলাম।
যাবতিয় কেমিক্যাল, মলিকিউলের মডেল আর ফরমাল্ডিহাইডে সংরক্ষন করা অঙ্গ প্রত্যঙ্গ ভর্তি বয়ামের বাক্স দিয়ে কেমিস্ট্রি অফিস ভর্তি ছিল। জানালার পাশে কাঠের ডেস্কগুলোতে নানান ধরনের সাইন্টিফিক বই আর কাগজপত্র রাখা। একটা ডেস্কের উপর পুরাতন মডেলের একটা কম্পিউটার ছিল। বই খাতার আড়ালে লুকিয়ে থেকে উঁকি মারছিল একটা প্রিন্টার। ঘুলঘুলি থেকে আসা আলোতে বাতাসে ভেসে থাকা ধুলো পরিস্কার চোখে পড়ছিল।
“উমম…প্রথমে চল ময়লাগুলো লেকচার হলে সরিয়ে ফেলা যাক, একটা নীল রঙের প্লাস্টিকের ওয়েস্ট পেপার বাস্কেটের দিকে ইশারা করলেন। ওটার ভেতর দলামোচা করা কাগজের বলে ভর্তি। আমি মাথা ঝাঁকিয়ে ময়লার ঝুড়িটা নিয়ে লেকচার হলের দিকে এগুলাম।
***
“কার এত ঠেকা পড়েছে লাঞ্চ বাদ দিয়ে এই কাজ করার?” কেউ একজন আমার পাশ থেকে বিড়বিড় করে বলল, যখন কেমিস্ট্রি টিচার সাহায্য চাইলেন। আমি কি বলেছিলাম মনে নেই, কিন্তু সে আমার উত্তর শুনে হেসেছিল এটুকু মনে আছে। নিশ্চয়ই বোকার মত কিছু একটা বলেছিলাম।
আমার হাসিখুশি ক্লাসমেটদের সাথে অভিনয় করা আমার জন্য সহজই ছিল। আমি যদি জনপ্রিয় টিভি শো আর অন্যান্য প্রোগ্রাম নিয়ে ঠিক মত কথা বলতে পারি তাহলে তাদের সাথে খাপ খাওয়ানো কোন ব্যাপারই না। সবাই ভাবত আমি মিশুক ধরনের একটা ছেলে। ফলে উটকো ঝামেলা এড়ানো আমার পক্ষে সহজ হতো।
উটকো ঝামেলাগুলো কি ধরনের? কিন্ডারগার্টেনে থাকতে, আমার মাথায় একবার ভুত চেপেছিল কালো মার্কার দিয়ে পুতুলের মুখ কালো করে দেয়া আর হাত-পা কেটে ফেলা। কিন্তু আশেপাশের মানুষজন এই ব্যাপারটা নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়ল। আমার মা আর শিক্ষকদের চেহারা আমার এখনো স্পষ্ট মনে আছে।