অন্যদিকে কিটাযাওয়া নাটসুমি ঘিঞ্জি গেটগুলো পার হয়ে গিয়েছে। অল্প কিছু গেটের সামনে বিশাল একদল লোক জমা হয়ে তাদের সময় আসার জন্য অপেক্ষা করছিল। তাদের মাথা আর পিঠের জন্য আমরা কিছু দেখতে পাচ্ছিলাম না। নাটসুমিকে চোখে পরছিল না। সে মোরিনোকে খেয়াল না করে স্টেশনের ভেতর ঢুকে গিয়েছিল।
মোরিনো আবার একজনের সাথে ধাক্কা খেল, মধ্যবয়স্ক বিশালদেহী এক লোক। মনে হল যেন কোন ভারি ট্রাকের সাথে একটা ট্রাইসাইকেলের সংঘর্ষ হলো। ও ধাক্কা খেয়ে আমার উপর এসে পড়ল। ওর মাথা আমার চোয়ালে লেগে চোখে অন্ধকার দেখলাম। গত কয়েক মাসে এত কিছু হলেও এরকম ক্ষতি আমার আর হয়নি। মোরিনো অবশ্য সেটা খেয়াল করেছে মনে হল না। ওর মনোযোগ ছিল কিটাযাওয়া নাটসুমি যেদিকে অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিল সেদিকে। সে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে জোরে চিৎকার করে ডাকল,
“নাটসুমি!”
এর আগে কখনো আমি ওকে জোরে কথা বলতে শুনিনি। এত জোরে তো প্রশ্নই আসে না। ওর শুকনো শরীরের ভেতর কোথাও মনে হলো একটা অ্যাম্পলিফায়ার বসানো আছে। আশেপাশের ভিড়ের শব্দ মুহূর্তের জন্য নিরব হয়ে গেল। কিছু লোকজন থেমে গিয়ে ওর দিকে তাকাচ্ছিল।
মোরিনো আবার হাঁটা শুরু করল। যারা যারা ওর চিৎকার শুনেছে তারা স্বরে গিয়ে ওকে জায়গা করে দিল। আমিও পিছে পিছে গেলাম।
“মোরিনো?” কিটাযাওয়া নাটসুমির গলা শোনা গেল। মানুষের ভিড় থেকে বেরিয়ে আসতে দেখা গেল ওকে। গেটের অন্য পাশে দাঁড়িয়ে আছে। সে নিশ্চয়ই মোরিনোর গলা শুনে ফিরে এসেছে। অবাক চোখে আমার দিকে তাকিয়ে থাকল। আমাদের মাঝে একটা বন্ধ গেট। মোরিনো একটা গেট আটকে রাখায় দ্রুত আমাদের আশেপাশে ভিড় জমে গেল। যদিও মারিনো সেটা খেয়াল করল বলে মনে হলো না।
“নাটসুমি, এটা তোমার জন্য,” মোরিনো ক্যানটা বাড়িয়ে দিয়ে বলল।
“ধ-ধন্যবাদ,” কিটাযাওয়া নাটসুমি ইতস্তত করে ক্যানটা নিল।
“একটু আগের বাজে মেজাজের কারনে আমি দুঃখিত। তোমার সাথে আমার আরো কথা বলা উচিত ছিল। আমি শুনেছি তোমার বোনের সাথে তোমার সম্পর্ক ঠিক হয়ে গিয়েছে।”
গেট দিয়ে যেতে না পেরে অনেক লোকজন আমাদের দিকে তাকিয়ে ছিল। স্টেশন অ্যাটেন্ডেন্টরা সমস্যা বুঝতে পেরে ভিড় ঠেলে আমাদের দিকে আসার চেষ্টা করছিল। আমি মোরিনোর হাত ধরে টানলাম। ওকে ওখান থেকে সরিয়ে আনতে চাইলাম, কিন্তু ও বাধা দিল, সেখান থেকে নড়ল না।
“আমার সাথেও আমার বোনের সমস্যা ছিল, যখন…কিন্তু ফলাফল ভালো হয়নি…যাই হোক আমি শুধু তোমাকে অভিনন্দন জানাতে চাইছিলাম, এই আরকি।”
এরপর আমি ওকে সেখান থেকে টেনে বের করে আনতে পারলাম। ওর শরীর একদম হালকা ছিল, যেন কোন ওজনই নেই। লোকজনের সোত আমাদের পাশ কাটিয়ে গেটের দিকে এগিয়ে গেল, কিটাযাওয়া নাটসুমি সেই সোতে অদৃশ্য হয়ে গেল। তার আগে আমি ওকে হাসতে দেখলাম, মোরিনোকে ধন্যবাদ জানিয়ে।
মোরিনো আমার পিছু পিছু আসতে লাগল, ক্লান্ত মনে হচ্ছে। ওর ব্যাগটা কোথাও হারিয়ে ফেলেছে।
আমি এদিক ওদিক তাকিয়ে ব্যাগটা খুঁজে পেলাম। একটু আগে যেখানে দাঁড়িয়ে ছিলাম আমরা সেখানে দেয়ালে ঠেশ দিয়ে রাখা।
আমি ওর হাত ধরে টেনে নিয়ে বিদেশী নারীর ছবির সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। ভিড়ের মধ্যে ওকে টেনে আনা কষ্টকর ছিল অবশ্য। শক্ত করে হাত ধরে ছিলাম যেন আলাদা না হয়ে যাই। ও মাটির দিকে তাকিয়ে আছে, কোনদিকে যাচ্ছে তা নিয়ে ওর কোন হুঁশ নেই। ওর ঠোঁটগুলো কাঁপছে, যেন কিছু বিড়বিড় করছে সে। ভিড়ের শব্দের কারনে শুনতে পাচ্ছি না আমি।
ভিড় ঠেলে ওর ব্যাগ রাখা জায়গাটায় পৌঁছানোর পর শুনলাম ও বলছে, “আমার মনে হয় তুমি আমার ঠিক বিপরীত, কামিয়ামা,” সে এক কথাই বার বার ফিসফিস করে বলছিল। আমাকে বাসায় যাওয়ার জন্য ট্রেন নিতে হবে। আর ওকে এখান থেকে একা একা হেঁটে বাসায় যেতে হবে। ওর অবস্থা দেখে মনে হচ্ছিল না সেটা পারবে।
“প্রথমে আমি ভেবেছিলাম তুমি আমার মতই। তোমাকে দেখে আমার বোনের কথা মনে পড়ত। কিন্তু তুমি তা নও। আমাদের মধ্যে কোন মিল নেই।”
মোরিনোর ব্যাগটা ছিল একটা সাধারণ ধরনের কালো ব্যাগ। আমি ওটা তুলে ওর হাতে দিলাম। এক সেকেন্ড পরে সেটা আবার নিচে পড়ে গেল।
ব্যাগটা আবার তুলে ওর হাতে পেঁচিয়ে দিলাম। কিন্তু কোন কাজ হল, মনে হচ্ছিল ও ব্যাগ বহন করার জন্য খুব বেশি ক্লান্ত। ওর আঙুলগুলো ব্যাগের ওজন বহন করতে পারছে না। আঙুলের ফাঁক গলে ব্যাগটা খসে পড়ল।
“মাঝে মাঝে আমার মনে হয় তুমি উপরে উপরে হাসছ কিন্তু তোমার ভেতরটা শূন্য। শুনতে খারাপ লাগলে আমি দুঃখিত, কামিয়ামা। কিন্তু আমার তাই মনে হয় যখন তোমাকে অন্যদের সামনে হাসিখুশি অবস্থায় দেখি। আর মাঝে মাঝে তোমার জন্য আমার সত্যি সত্যি দুঃখ হয়।”
আমার দিকে না তাকিয়ে মোরিনো কথাগুলো বলে যাচ্ছে। ওর গলা কাঁপছে, মনে হচ্ছে যেন একটা ছোট বাচ্চা যেকোন মুহূর্তে কান্নায় ভেঙে পড়বে।
“কিন্তু আমি একদম উল্টো ধরনের।”
মুখ তুলে আমার দিকে তাকাল, চোখে চোখ রাখল। আমি ওর চেয়ে লম্বা হওয়ার কারনে এটুকু দূরত্বের মধ্যেও ওকে উপরের দিকে তাকাতে হলো। ওর অভিব্যক্তি বরাবরের মতই শূন্য ছিল। কিন্তু চোখগুলো ঈষৎ লাল হয়ে ছিল, ভেজা দেখাচ্ছিল।