স্টেশনের সামনে খালি জায়গাটায় যখন আমরা পৌঁছলাম, ততক্ষণে পুরোপুরি সন্ধ্যা নেমে গিয়েছে। কিন্তু আশেপাশে প্রচুর দোকান থাকায়, আর সেগুলো থেকে উজ্জ্বল আলো আসার কারনে অন্ধকার তেমন একটা ছিল না।
স্কুল-অফিস ছুটি হয়ে যাওয়ায় স্টেশন ভর্তি মানুষ ছিল, সবাই বাসায় ফিরছে। বিশাল স্টেশনটার প্রথম তলায় চারকোনা একটা প্রবেশ পথ ছিল, অনেকটা টানেলের মত। লোকজন এমনভাবে ঢুকছে আর বের হচ্ছে। সেখান থেকে, মনে হচ্ছে স্টেশনটা নিঃশ্বাস টেনে ভেতর নিচ্ছে আবার ছাড়ছে।
প্রবেশ পথের কাছে কিটাযাওয়া নাটসুমিকে আমি বিদায় জানালাম। সে হাত নেড়ে তারপর টিকেট মেশিনগুলোর দিকে চলে গেল। এমনভাবে ভিড়ের মধ্যে ঢুকে গেল যেরকম সাইন্স ফিকশন মুভিতে স্পেসশিপ শত্রু বহরে সাঁ করে ঢুকে যায়।
মোরিনো আর আমি দেয়াল ঘেঁসে দাঁড়ালাম যাতে লোকজনের চলাচলে বাধা না হয়। আমাদের দুজনের কারোরই ভিড়, চেঁচামেচি পছন্দ না। এসব জায়গায় বেশিক্ষণ থাকলে মাথাব্যথা শুরু হয়ে যায়।
“কিটাযাওয়া নাটসুমির সাথে ওর বোনের মিল দেখে অবাক হয়েছ না?” আমি বললাম।
তারচেয়েও যেটা জরুরি সেটা হলো, মানুষ বুঝে তোমার কথা বলার ভঙ্গি বদলে যাওয়া। সমস্যা হয় না?” মোরিনো তার হাত দুটো ভাঁজ করে আছে। ডান হাতে ধরা সোডা ক্যানটা বাম হাতের নিচ থেকে উঁকি দিচ্ছিল। আমি নিশ্চিত ওর শরীরের তাপে সোড়া এখন গরম হয়ে গিয়েছে।
মোরিনো লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা কিটাযাওয়া নাটসুমির দিকে তাকাল। “তুমি কি করে এত স্বাভাবিকভাবে হাসতে পারো আমি বুঝি না।”
“আনন্দিত হওয়ার কারনে আমি হাসি না।”
কথাবার্তা যাই হোক না কেন তা থেকে আমার কোন আনন্দ হয় না। সবসময় মনে হয় আমি যেন কোন গভীর অন্ধকার গর্তের তলায় দাঁড়িয়ে আছি। কিন্তু সাথে সাথে অবচেতনভাবে অভিনয় চালিয়ে যাই, সাবধান থাকি যেন কেউ সেটা ধরতে না পারে।
“আর সেও খুব একটা হাসে না, আমার সাথে কথা বলার সময় খালি একটু হাসল, কিন্তু ইদানিং কিছুদিন ওর অবস্থা এরকম ছিল না।”
মোরিনো ভুরু কুচকাল। “মেয়েটা হাসে না? আমার কাছে তো ওকে বেশ হাসিখুশি মনে হলো।”
আমি মোরিনোকে কিটাযাওয়া নাটসুমির সাথে ওর বোনের সম্পর্কের একটা সাধারণ বর্ণনা দেয়ার চেষ্টা করলাম। দুই বোনের মধ্যে চেহারায় মিল থাকলেও, ওদের মধ্যে বেশ লম্বা সময় ধরে একটা অপ্রীতিকর অবস্থা চলছিল। নাটসুমির ধারণা ছিল ওর বোন ওকে ঘৃণা করে, যে কারনে ও হাসতে ভুলে গিয়েছিল।
মোরিনো চুপচাপ শুনল, কিছু বলল না।
“আমি কিটাওয়া হিরোকোর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়াতে গিয়েছিলাম, বুঝতেই পারছ কি কারনে। ও আমাকে ওদের এই সমস্যা সম্পর্কে আমাকে তখন বলেছিল। কিন্তু এরপর একদিন ও একটা টেপ পেল যেটায় হিরোকোর কণ্ঠ রেকর্ড করা ছিল..”
বোনের মুখোমুখি হওয়ার একটা সুযোগ ওর সামনে এল যদিও ও ভেবেছিল আবার ওদের দেখা হওয়ার কোন সম্ভাবনা নেই।
আমি ওকে গত রাতের ঘটনা, কিংবা খুনির কথা কিছুই বললাম না। বললে ঝামেলা বাড়তে পারে। আমি শুধু ওকে সংক্ষেপে জানালাম টেপের কথাগুলো শুনে কিভাবে কিটাযাওয়া নাটসুমির মধ্যে পরিবর্তন এসেছে।
আমার মনে পড়ল ও কিভাবে টেপ রেকর্ডারটা জড়িয়ে ধরে ফ্লোরে গুটিসুটি মেরে শুয়ে ছিল।
আমি তখন ছুরি হাতে দাঁড়িয়ে ছেলেটার কাপড়ে রক্ত মুছছিলাম। টেপের বর্ণনা থেকে ছোটবেলায় ওরা কিভাবে একসাথে খেলাধুলা করত তা কল্পনা করতে আমার কোন কষ্টই হয়নি।
আমি যখন এগুলো মোরিনোকে বলে শেষ করলাম, ও তখনো দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়েছিল। হাত দুটো তখনো ভাঁজ করা। দৃষ্টি নিচের দিকে। মনে হচ্ছে গভীর কোন চিন্তায় ডুবে গিয়েছে। চোখগুলো আধ বোজা। মাথার উপর থেকে উজ্জ্বল আলো চোখের পাতার উপর পড়ায় চোখের নিচে ছায়া পড়েছে।
“এসবের কোন কিছুই আমার স্ট্র্যাপবুকে নেই,” সে বলল, এতটা আস্তে যে আমি প্রায় শুনতেই পারিনি। সে মাথা তুলে টিকেট মেশিনের লাইনে দাঁড়ানো কিটাযাওয়া নাটসুমির দিকে তাকাল।
লাইন সামনে এগুলে নাটসুমি মেশিনে কয়েন ফেলল। একটা বাটনে চাপ দিয়ে কাছাকাছি এক স্টেশনের টিকেট নিল। তারপর ভিড়ের দিকে এগিয়ে গেল। মানুষের স্রোতের মধ্যে মাঝে মাঝে এক ঝলক দেখা যাচ্ছে।
মোরিনো হাতে ধরা ক্যানটার দিকে তাকাল। তারপর দেয়াল থেকে সোজা হয়ে দাঁড়াল। এক মুহূর্ত পর ওর লম্বা কালো চুলও ওকে ফলো করল। ওর হাঁটা দেখে মনে হচ্ছিল শান্ত নদীর পানির মত, হঠাৎ নিস্তব্ধে আবার বইতে শুরু করেছে।
আমার বুঝতে মুহূর্তখানেক লাগল যে ও হাঁটতে শুরু করেছে। কি করতে চাইছে বুঝতে না পেরে আমি খালি তাকিয়ে থাকলাম। ভিড়ের মধ্যে অদৃশ্য হওয়ার আগ পর্যন্ত ওকে ফলো করিনি।
মোরিনোর দৃষ্টি কিটাযাওয়া নাটসুমির উপর বিদ্ধ হয়ে ছিল, যে ইতিমধ্যে টিকেট কিনে প্লাটফর্ম গেটের দিকে এগুচ্ছে।
মোরিনো ইয়োরু নিশিতে পাওয়া মানুষের মত ওর পিছু পিছু যেতে লাগল। ভিড়ের মধ্যে হাঁটার অভ্যাস না থাকায় এদিক ওদিক লোকজনের ধাক্কা খাচ্ছিল। স্যুট পরা নারীপুরুষের ধাক্কা খেয়ে পিছিয়ে এসে আবার জোর সামনে এগুচ্ছে। এর আগে আমি কখনো কাউকে ভিড়ের মধ্যে এত যুদ্ধ করতে দেখিনি। ওর কাছে পৌঁছে যেতে আমার কোন সমস্যাই হলো না।