দোকান থেকে আসা আলো নুড়ি পাথরের উপর আমাদের লম্বা ছায়া ফেলেছে। মনে হচ্ছে ছায়ার পুতুল। সেগুলোর দিকে তাকিয়ে মাথা দোলাচ্ছে নাটসুমি।
“কিন্তু, ইটসুকি, আমি কখনো ভাবতেও পারিনি তোমার অনুভূতি এত কম।”
“তোমার মতই কম।”
“আমি দুশ্চিন্তা করছিলাম গত রাতে…তুমি সেফ উধাও হয়ে গেলে। সকালে তোমাকে ফোন করলাম, ফোন যাচ্ছিল না।”
“ও আমার ফোনটা ভেঙে ফেলেছিল।”
কিটাযাওয়া হিরোকোর খুনি আর আমি এক ক্লাসে ছিলাম এক সময়। ওকে ভালো করে চিনতাম না। যদি কখনো একসাথে একটুও সময় কাটাতাম তাহলে নিশ্চয়ই ওর মধ্যের অস্বাভাবিক ব্যাপার আমার চোখে পড়ত।
“কী করেছ…ওকে নিয়ে পরে?”
আমি ছেলেটার লাশ হাসপাতালের পেছনের ঘাসের নিচে চাপা দিয়েছি। ওর সব নিষ্ঠুরতা কেড়ে নিয়েছে আমার রুপালি ছুরি। অন্তত এভাবেই আমি পুরো ব্যাপারটা দেখি। ছুরিটা যখন ওর শরীরের গভীরে ঢুকে গিয়েছিল, ও গুঙিয়ে উঠেছিল। মুখ থেকে রক্ত ছিটকে বেরিয়েছিল। ছুরি ধরা হাতটা মনে হচ্ছিল অনেকদিনের পিপাসা মিটিয়ে নিচ্ছে।
“ও দৌড়ে পালায়। আমি পিছু নিয়েছিলাম, কিন্তু ধরতে পারিনি…”
সে নিজের রক্তের পুকুরের দিকে তাকিয়ে থাকে যেন কোন অর্থ ধরতে পেরেছে, যেন এটা সম্ভাব্য আরেকটা উত্তর ছিল।
হাঁটু গেড়ে বসে ও সহজভাবে নিজের মৃত্যু গ্রহন করে নেয়, যেভাবে কিটাযাওয়া হিরোকোর মৃত্যু গ্রহণ করেছিল। আমার দিকে তাকিয়ে ছুরিটার প্রশংসা করে, তারপর নিথর হয়ে যায়।
“ওহ, আমাদের কি পুলিশকে জানানো উচিত তাহলে?”
“তুমি যদি চাও। আমি কোন ঝামেলা চাই না। সুতরাং তুমি জানালে আমার কথা বাদ দিয়ে জানিও। হাজার হোক তোমার ঘরে চুরি করে ঢুকেছিলাম।”
রাস্তার দিকে তাকিয়ে দেখি দূরে কিছু একটা নড়ছে। মোরিনো। ফিরে আসছে।
“সকালে বাসায় পৌঁছানোর পর দেখি বাবা পাগলের মত করছে।” নাটসুমি পার্কিং এর বাম্পারে লাথি দিতে দিতে বলল। হাসছে। সে সাইকেল চালিয়ে বাসায় ফিরে গিয়েছিল। বাসায় ফেরার আগেই ওর বাবা মা টের পেয়ে গিয়েছিলেন যে ও বাসায় নেই। তারা আতংকিত হয়ে পড়েন। সে যখন ক্লান্ত চেহারা নিয়ে দরজা খুলে ঢুকল, তারা ছুটে এসে ওকে জড়িয়ে ধরেন।
“মা আমাকে দেখে কান্নায় ফেটে পড়েন। আপুর ঘটনার পর এটা হওয়াই স্বাভাবিক। বাসায় ফিরে আমার মনে হচ্ছিল আমি বেঁচে আছি, আমার বাবা-মাও বেঁচে আছেন। আমরা চিন্তা করছি আগামি বছর অন্য কোথাও বাসা নেব। এখান থেকে দূরে কোথাও চলে যাব।”
সে মাথা তুলে রাস্তার দিকে তাকাল। দোকান থেকে আসা আলোতে ওর কাঠামো উজ্জ্বল দেখাচ্ছে।
“তোমার সাথে আর দেখা হবে না।”
ড্রিঙ্কস হাতে নিয়ে মোরিনো একটু দূরে একটা টেলিফোনের খাম্বায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আমাদেরকে দেখছিল। রাস্তা দিয়ে ছুটে যাওয়া গাড়ির বাতাসে ওর চুল দুলছে। দেখতে ছোট ম্যাচ গার্লের মত লাগছে ওকে।
“শেষ হয়নি?” মোরিনো জিজ্ঞেস করল। “আর একটু,” আমি বললাম। বিড়বিড় করে কী জানি বলে অন্যদিকে ঘুরে তাকাল সে। ওখান থেকে আমাদের কথা শুনতে পাবে না। আমি ওর শুকনো কাঁধের দিকে তাকালাম।
“মোরিনো কি…” কিটাওয়া নাটসুমি বলা শুরু করল, আমার দৃষ্টি খেয়াল করে।
“কি?”
“কিছু না, ভুলে যাও…সে হয়তো আমাদের নিয়ে ভুল ভাবছে। তুমি কি ওকে জানাবে কি ঘটেছে?”
“দরকার না পড়লে না। আমার কোন ইচ্ছা নেই।”
“তাহলে সে জানতে পারছে না, তুমি ওকে রক্ষা করেছ। ইটসুকি, তুমি কি ওখানে গিয়েছিলে আমাকে রক্ষা করতে? নাকি ওর কাছে পৌঁছানোর আগেই আগুন থামাতে গিয়েছিলে?” নাটসুমি সোজাসুজি আমার চোখের দিকে তাকাল।
“ঠিক বলেছি তাই না? তুমি ওকে ভালোবাসো?”
প্রেম-ভালবাসার মত কিছু নয়…এক ধরনের ঘোর বলা যেতে পারে। কিন্তু সেটা আমি মুখে উচ্চারণ করলাম না।
কিটাযাওয়া নাটসুমি অন্যদিকে তাকাল, ডান হাত দিয়ে বাম কাঁধ ধরে আছে।
“কাঁধ ব্যথা করছে?”
সে মলিনভাবে হেসে সায় দিল।
“ঘোরার আগে ও এখানে হাত রেখেছিল।”
“ও?”
“বাদ দাও। আর কতক্ষন মোরিনোকে দাঁড় করিয়ে রাখবে?”
মোরিনো তখনো টেলিফোনের খাম্বার সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আমি ওকে ডাক দিয়ে জানালাম যে আমাদের কথা শেষ।
মোরিনো আস্তে ধীরে আমাদের কাছে এল। ওর হাতে একটা ট্রিাসের ক্যান। আমি ইশারায় দেখালাম আমরা তো মানুষ তিনজন এখানে। সে বলল অপেক্ষা করতে করতে দুই ক্যান সে খেয়ে ফেলেছে। চেহারা দেখে অবশ্য বরাবরের মত বোঝার উপায় নেই ওর মেজাজ কতখানি খিঁচড়ে আছে।
আমরা তিনজন একসাথে গল্প করতে করতে হেঁটে স্টেশনের দিকে গেলাম। পড়াশোনা, কলেজ ভর্তি পরীক্ষা-এগুলো নিয়ে কথা হচ্ছিল, গুরুত্বপূর্ণ কিছু না। আমি আমার অভিনয় চালিয়ে যাচ্ছিলাম। কিটাওয়াকেও হাসিখুশিই দেখাচ্ছিল। বেশ কয়েকবার হাসল।
মোরিনো কয়েক কদম পেছনে ছিল। আমি মাঝে মাঝে ফিরে ওকে দেখছিলাম। ওর এক হাতে ব্যাগ, আরেক হাতে সোডা ক্যান ধরে। যেন বুঝতে পারছে না ক্যানটা নিয়ে কী করবে। পায়ের দিকে তাকিয়ে হাঁটছে। সে। লম্বা চুলগুলো সামনে ঝুলে মুখ ঢেকে রেখেছে। কোন কথা বলছে না। আমাদের গল্পের মধ্যে ঢোকার কোন চেষ্টাও করল না। ওর দিকে তাকালেও আমি ভান করলাম কিছু খেয়াল করিনি, সব স্বাভাবিক আছে।