গত কয়েকবছর আমাদের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক আর ছিল না। আমরা ছিলাম দু-জন অপরিচিত মানুষ যারা কিনা এক ছাদের তলায় বাস করছিল। আমি ভেবেছিলাম আপু আমাকে ঘৃণা করত।
“হয়তো এরকম মেসেজ দেয়াটা পুরো ব্যাপারটাকে আরো খারাপ করে তুলবে…আমি জানি এরকমই হবে। কিন্তু তারপরেও আমি খুশি এই ভেবে যে আমি ক্ষমা চাওয়ার সুযোগ পেয়েছি…মারা যাওয়ার আগে হলেও…আমি বলতে চাইছি, আমার কথা চিন্তা করে তোমার মুখে যদি হাসি না আসে, তাহলে তার চেয়ে খারাপ কিছু আর হতে পারে না আমার জন্য…’
আমি টেপ ডেকটা জড়িয়ে গুটিসুটি মেরে ফ্লোরে শুয়ে থাকলাম। মাির প্রিয় বোনের কষ্ঠ শুনছি। মনে হচ্ছে আমার প্রিয় বোনটা আমার কাছে ফিরে এসেছে।
‘এখানে শুয়ে আমার মনে পড়ছে, ছোট থাকতে আমরা একসাথে কি কি করতাম…’
আমি চোখ বন্ধ করে শুনছি।
‘পাহাড়ের উপর একটা বড় বন ছিল…’
আমার মনে আছে, যখন ছোট ছিলাম তখন আমরা কি কি দেখেছিলাম।
অন্ধকার, ঠান্ডা কংক্রিটের দেয়াল…সব কোথায় মিলিয়ে গেল, আমি দাঁড়িয়ে আছি নুড়ি বেছান পথের উপর, মাথার উপর সূর্য।
গার্ডরেইল, পোস্টগুলো-সব অনেক বড় বড় ছিল। আমি বাচ্চাদের ছোট জুতো পরে ছিলাম। পাহাড়টা অনেক খাড়া দেখাচ্ছিল। একদিকে ঘরবাড়ি, আরেকদিকে গার্ড রেইল। নিচে শহরের সুন্দর দৃশ্য।
‘তোমার মনে আছে আমরা হাত ধরাধরি করে হেঁটেছিলাম?
আমি পরিচিত একটা বাচ্চার কণ্ঠ শুনতে পেরে ঘুরে দাঁড়ালাম। আপু দাঁড়িয়ে আছে সেখানে।
ও আমার চেয়ে বেশি লম্বা ছিল না, আর সবাই বলত আমাদের দেখতে একইরকম লাগত।
আপু এসে আমার হাত ধরল। পাহাড়ের চূড়ার দিকে আঙুল তুলে প্রস্তাব করল সেখানে যাওয়ার জন্য।
আমি খুবই উত্তেজিত ছিলাম। আমি ওর হাত ধরে দৌড়াচ্ছিলাম। উষ্ণ সূর্যালোক আমাদের পেছনে ছোট ছায়া ফেলেছিল। সেগুলোও আমাদের সাথে ছুটছিল। পাহাড়ের চূড়ার লম্বা গাছগুলোর দিকে দৌড়ে যাওয়ার সময় কংক্রিটের উপর আমাদের স্নিকারগুলো ক্যাচকোচ শব্দ করছিল।
পাহাড়ের উপরে গিয়ে আমরা বনের ভেতর ঢুকেছিলাম। ঠান্ডা বাতাসে আমাদের ঘাম শুকিয়ে গেল। বনের ভেতর দিয়ে আমরা হেঁটে গেলাম। একসময় একটা খোলা জায়গা পাওয়া গেল যেখান থেকে নিচে দূরের শহরের চমৎকার দৃশ্য দেখা যাচ্ছিল। আমরা হাত ধরে সেদিকে তাকিয়ে ছিলাম।
ওর নরম উষ্ণ হাতের স্পর্শ পাচ্ছিলাম। ও আমার পাশে দাঁড়িয়েছিল। আমার দিকে তাকিয়ে হাসল, সুন্দর শ্বান্তগুলো চকচক করে উঠল হাসির সাথে।
শহরের উপরে অনেক উঁচুতে একটা পাখি উড়ে যাচ্ছিল।
একটা সাদা পাখি, ডানাগুলো ছড়িয়ে উড়ছিল। আমি ভেবেছিলাম পাখিটা নিশ্চয়ই বড় নদীটার কোথাও থাকে। যেই নদীটা শহরের মাঝখান দিয়ে বয়ে গিয়েছে। পাখিটার ডানাগুলো একদমই নড়ছিল না। অসীম নীল আকাশে ভেসে বেড়াচ্ছিল শুধু।
‘নাটসুমি, আমি মরতে যাচ্ছি, কিন্তু তুমি তো এখনো জীবিত। তোমাকে বেঁচে থাকতে হবে। আমাকে কথা দাও, তুমি আবার হাসবে-না হাসলে তোমাকে আমি ক্ষমা করব না। গুডবাই
ওর কণ্ঠ মিলিয়ে গেল, আর শোনা গেল না। ওর নিঃশ্বাসের শব্দও টেপ থেকে হারিয়ে গেল। স্পিকারগুলো থেমে গেল। আপুর স্বীকারোক্তি সমাপ্ত হয়েছে। স্বচ্ছ প্লাস্টিকের ভেতর দিয়ে আমি তখনো ক্যাসেটটাকে নিরবে ঘুরতে দেখতে পাচ্ছিলাম। আমার গাল বেয়ে এক ফোঁটা অশ্রু ডেকটার উপর গিয়ে পড়ল।
নিরবে আমি ফিস ফিস করে বললাম, “আমি দুঃখিত…কিন্তু তোমাকে ধন্যবাদ।”
জায়গাটা অন্ধকার আর খুবই নিরব। পরিত্যাক্ত হাসপাতালের ভেতর ফিরে এসেছি আমি। এক মুহূর্ত আগেও আমি আপুর সাথে ঐ পাহাড়টার উপরে ছিলাম।
কতক্ষন ধরে আমি এখানে পড়ে পড়ে কাঁদছি?
রুমের ভেতর শুধু আমি, টেবিল আর লাইটটা। ছেলেদের কাউকে দেখা গেল না।
ফ্লোরের উপর আলোটা একটা অংশ আলোকিত করে রেখেছে। চোখ পিটপিট করে আমি টের পেলাম ফ্লোরটা ভেজা। ফ্লোরে এক পুকুর রক্ত জমে আছে। শুকনো রক্ত না, টাটকা রক্ত। আমি মনে মনে প্রার্থনা করলাম রক্তটা যেন ইটসুকির না হয়।
উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করলাম, টেপ ডেকটা তখনো বুকের সাথে চেপে ধরে রেখেছি। প্রথমে পাগুলো অত্যন্ত দূর্বল লাগছিল। অনেক সময় নিয়ে কোন রকম পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়াতে সক্ষম হলাম।
রুম থেকে বেরিয়ে অসংলগ্নভাবে হাঁটছিলাম। ইটসুকির নাম ধরে ডাকলাম। আমার কণ্ঠ দেয়ালে প্রতিধ্বনি তুলে অন্ধকারে হারিয়ে গেল।
হাসপাতালের প্রবেশ পথের কাছে দাঁড়িয়ে ইটসুকির জন্য অপেক্ষা করলাম। ঠান্ডা বাতাস কাপড় ভেদ করে ঢুকছে। আমি কাঁপতে কাঁপতে অন্ধকারে বসে ছিলাম। একসময় সূর্য উঠল। ইটসুকি কিংবা অন্য ছেলেটার কোন চিহ্ন দেখা গেল না।
উপসংহার
“আরে তেমন কোন ব্যাপার না, কুকুরের সাথে খেলতে গিয়ে পড়ে গিয়েছিলাম,” সিঁড়ি থেকে নামার সময় মোরিনোকে বললাম। এক হাতে ব্যাগ ধরে আছি।
ডিসেম্বরের ৪ তারিখ। স্কুলের পর কথা বলতে বলতে ক্লাস থেকে বের হচ্ছিলাম আমরা। মোরিনো আমার গলার লাল দাগটার দিকে ইঙ্গিত করে জানতে চাইল।
“তাই? কোন সন্দেহ নেই যে সে তোমাকে খুন করতে চাইছিল।”
“কুকুরটা?”
“আমি পুরোপুরি নিশ্চিত।” সে মাথা ঝাঁকিয়ে ঘোষণা দিল।
সত্যি বলতে আগের রাতে পরিত্যাক্ত হাসপাতালে আমি আহত হয়েছিলাম।