“কে..?” আমি ঢোক গিলোম।
পায়ের শব্দটা দরজার কাছ থেকে এসে অপারেটিং টেবিলের কাছে থামল।
ছেলেটা আস্তে করে আমার মাথা থেকে হাত সরিয়ে নিল। আবার দেখতে পাচ্ছিলাম, সামনের দেয়ালে তিনটা ছায়া তখন।
‘আমি তোমাকে আঘাত করার জন্য অনেক কিছু বলেছি…কিন্তু তোমার কোন দোষ ছিল না…’
আমি না, ছেলেটাও না, তৃতীয় ছায়াটা নড়ে উঠল। স্টপ বাটনে চাপ দিতে শুনলাম, আপুর কণ্ঠ থেমে গেল। রুমের ভেতর আবার নিরবতা নেমে এল।
টেবিল বসেই আমি মাথা ঘুরালাম। ছেলেটা আমার পিছে দাঁড়িয়ে, ওর পিঠ আমার দিকে ফেরানো, রুমের অন্যদিকে তাকিয়ে আছে। ওর পেছনে, দেয়ালের কাছে ইটসুকি দাঁড়ানো।
ইটসুকি টেপ ডেক থেকে আঙুল সরিয়ে বলল, “আমি টেপগুলো নিয়েছি, নাটসুমি।”
আমি ভেবেছিলাম আর কখনো ওর কণ্ঠ শুনতে পাব না। সে এখানে কেন? নাকি পুরোটা আমার কল্পনায় ঘটছে? না, সে বাস্তবেই সেখানে আছে। আলোতে ছায়া পড়ছিল ওর। কোন কল্পনা নয়।
“হাসপাতালটা অনেক বড় হওয়ার কারনে, খুঁজে পেতে সমস্যায় পড়েছিলাম। হিরোকোর কণ্ঠ শুনতে না পেলে হয়তো তোমাদের খুঁজে পেতাম না।”
সেদিন সন্ধ্যায় ওর ফোন মনে পড়ল আমার। আমি ওকে বলেছিলাম আমি স্কুলের বাইরে। সে হয়তো তখন আমার রুমে ছিল আর নিশ্চিত হচ্ছিল যে আমি হঠাৎ এসে হাজির হব না সেখানে।
রেস্টুরেন্টে বসা অবস্থায় আমি ওকে বলেছিলাম যে বাবা-মা দরজা লক করতে ভুলে যায়।
সেকারনে ও সহজেই বাসায় ঢুকতে পেরেছিল। তারপর আপুর নাম লেখা টেপগুলো দেখতে পেয়ে অবাক হয়। ওর এখানে আসার ব্যাখ্যা পাওয়া যাচ্ছে। দ্বিতীয় টেপে এই জায়গার কথা আর সময় দেয়া ছিল।
“কামিয়ামা যে! অনেকদিন দেখা হয়নি আমাদের,” ছেলেটা বলল, ওর এক হাত আমার বাম কাঁধে রাখা। হাতের তালু গরম। তারপর অপারেটিং টেবিল থেকে সরে গেল। ইটসুকির মুখোমুখি হলো। আমি নড়তে পারছি না। নিথর বসে ইটসুকির দিকে চেয়ে রইলাম।
“হ্যালো,” ইটসুকি বলল। ছেলেটার নাম ধরে ডাকল, একবারের জন্যও চোখ সরাল না। ওকে দেখে মনে হচ্ছে আমি যে এখানে আছে সেটা ইটসুকি ভুলে গিয়েছে।
তারা চুপচাপ একজন আরেকজনের দিকে চেয়ে থাকল, রুমের দুই মাথায় দু-জন দাঁড়িয়ে থেকে। অপারেটিং চেম্বারের ভেতর শব্দহীন টানটান উত্তেজনা। নিরবতা যেন আমার কানে আঘাত করছিল।
আপুর কণ্ঠ শুনতে ইচ্ছা করছিল আমার। টেবিলে বসে থেকে আমি ইটসুকির পায়ের দিকে তাকালাম।
প্লেয়ারে তখনো টেপটা ঢোকানো ছিল।
আমি টেবিলের কোণা চেপে আমার আঙুলে সংকেত পাঠালাম, যেন তারা নড়াচড়া করে। কিন্তু সেগুলো অবশ হয়ে ছিল।
“তুমি ওকে উদ্ধার করতে এসেছ?” ছেলেটা জানতে চাইল। ওর কণ্ঠস্বরে নিরবতা ভেঙে গেল। কিন্তু তাতে উত্তেজনা মনে হলো আরো বেড়ে গেল।
আমি আবার আমার পেশিগুলোকে বললাম নড়াচড়া করতে, কিন্তু আমার হাত-পা আমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে গেল। বুক দ্রুত লাফালেও শরীরের বাকি অংশ মনে হচ্ছিল ড্রাগ দিয়ে অবশ করে রাখা হয়েছে।
চোখ বন্ধ করে জোরে নিঃশ্বাস নিলাম আর প্রার্থনা করলাম।
প্লিজ, নড়াচড়া কর, টেপ প্লেয়ারটার কাছে হেঁটে যেতে দাও আমাকে…আমার আঙুলগুলো কাঁপতে লাগল।
“আমি কি কোন কিছুতে বাধা দিলাম?” ইটসুকির কণ্ঠ।
এখন যেহেতু আমার আঙুল কাঁপছে, সেটা একটা চেইন রিয়্যাকশনের মত সৃষ্টি করল। হাত আর পাও জেগে উঠল। কিন্তু পেশিগুলো টানটান হয়ে ছিল। নড়ছিল কিন্তু জোর পাচ্ছিলাম না। তারপরেও আমি টেবিল থেকে নিচে গড়িয়ে পড়ে যেতে পারলাম। যে টেবিলে আপু খুন হয়েছিল সেখান থেকে সরতে পেরে আমার নিজেকে জীবিত মনে হতে লাগল।
আমার পা এমনভাবে কাঁপছে যে উঠে দাঁড়ানো সম্ভব না। আমি হামাগুড়ি দিয়ে এগুতে লাগলাম। ফ্লোরের ধুলোয় মাখামাখি হয়ে গেলাম। অপারেটিং টেবিলে ঘুরে ইটসুকির পায়ের কাছে টেপ ডেকটা রাখা। ইটসুকি আর ছেলেটা তখনো কথা বলছিল, কিন্তু সেসব আমার কানে ঢুকছিল না। পোকার মত ঘষে ঘষে আমি এগুতে লাগলাম, টেপ ছাড়া আর কোন কিছুর চিন্তা আমার মাথায় নেই।
এক টুকরো কংক্রিটের উপর হাতের চাপ পড়ে সেটা হাতে ঢুকে গেল, কিন্তু পাত্তা দিলাম না। ছেলেটা বলেছিল মৃত্যু হল ধ্বংস। সে বলেছিল
আমি সবকিছু পেছনে ফেলে এসেছি, বেছে নিয়েছি মৃত্যু।
কিন্তু আমি এখনও মারা যাইনি। এখনো জীবন পুরোপুরি ছুঁড়ে ফেলিনি। এই পরিত্যাক্ত বিল্ডিঙে আমি এসেছি কিছু পাওয়ার জন্য। জীবনের বদলে যা চেয়েছি।
টেপ ডেকটার কাছাকাছি যেতে আপুর কথা মনে হচ্ছে।
টেপ ডেকের পাশে রাখা আলো আমাকে অন্ধ করে দিচ্ছে যেন। ইটসুকির পা নড়ল, আলোর সামনে এল। ওর ছায়া আমাকে পাশ কাটিয়ে চোখের আড়ালে চলে গেল। আমি মাথা ঘুরিয়ে দেখার চেষ্টা করলাম না।
অবশেষে একসময় টেপ ডেকটা স্পর্শ করতে পারার মত কাছে পৌঁছাতে পারলাম। হাত দিয়ে বুকের কাছে টেনে নিয়ে প্লে বাটনে চাপ দিলাম। আঙুল কাঁপছেল আমার।
প্লেয়ারটা যেন জ্যান্ত হয়ে উঠল, ক্যাসেটের টেপ আবার ঘুরতে শুরু করল। স্পিকার দিয়ে আপুর কণ্ঠ আবার বেরিয়ে এল। বাতাসে নয়, আমার হাতের নিচ থেকে ওর গলার কাঁপুনি বেরিয়ে এল।
‘নাটসুমি, আমি সবসময় তোমাকে নিয়ে চিন্তিত ছিলাম। প্রতিবার যখন তোমাকে উদ্দেশ্য করে খারাপ কিছু বলে ফেলেছি, সে নিয়ে আফসোস করেছি…তোমাকে বার বার কষ্ট দেয়ার জন্য আমি দুঃখিত…’