গ্রীষ্মকালীন ইউনিফর্ম বাদ দিলে, ও সবসময়ই কালো পরে থাকে। চুল থেকে জুতা পর্যন্ত সবকিছু কালো। মনে হয় যেন ও সর্বশক্তিতে চেষ্টা করে যাচ্ছে অন্ধকারের সাথে মিশে যেতে। আলো ওর কাছে যেন ঘৃণিত কোন বস্তু, সবসময় একশ হাত দূরে থাকা বাঞ্ছনীয়।
আমি একবার মোরিনোর শিববা দোকি (আবেদন পত্র) দেখতে চেয়েছিলাম, জানতে, কেন যে ও এই স্কুলে ভর্তি হতে এল।
“এখানের ইউনিফর্ম একদম সাধারণ আর কালো রঙের, শুধু সে কারনে…তুমি যখন প্রথমে ‘শিবো দোকি’ বললে আমি অন্য অর্থ ভেবেছিলাম…”
ও ব্ল্যাক বোর্ডে গিয়ে চক দিয়ে কানজিতে লিখল “মরণ ইচ্ছা।” সে যখন হাত তুলে লিখছিল ইউনিফর্মের লম্বা হাতা নেমে গিয়ে ওর হাত বেরিয়ে এসেছিল। ওর ত্বক একদম ফ্যাকাসে সাদা। দেখে মনে হয় যেন কোনদিন সূর্যের আলোর সংস্পর্শে আসেনি।
মোরিনোর চেহারা সুন্দর ছিল। ছেলেরা আগে মাঝে মধ্যে ওর সাথে খাতির জমানোর চেষ্টা করত। অন্তত একটা ঘটনা ঘটার আগ পর্যন্ত…এক শিক্ষক ওর সাথে এমন কিছু করার চেষ্টা করেছিল যেটা কিনা যৌন হয়রানির পর্যায়ে পড়ে। মোরিনো প্রথমে তার মুখে মরিচ পানি স্প্রে করে, তারপর ধীরে সুস্থে একটা ডেস্ক চেয়ার দিয়ে তাকে পিটিয়ে আধমরা করে ফ্লোরের উপর ফেলে রাখে। আমি লুকিয়ে লুকিয়ে পুরো ঘটনাটা দেখেছিলাম। এই ঘটনার পর ছেলেরা আর ভয়ে ওর সাথে কথা বলতে আসে না।
যে ঘটনাটার কথা আমি এখানে বলব সেটা আমাদের সম্পর্ক কিভাবে হল তা নিয়ে নয়। বরং অন্য একটা ব্যাপার, ওর ফ্যাকাসে হাতের দিকে তাকালে যে ঘটনার কথা আমার বার বার মনে পড়ে।
ঐ বছর বসন্তে, সব টিভিতে একটা ইন্টারেস্টিং কেস দেখাচ্ছিল। কেসটা কাটা হাত নিয়ে। যে কেসের সাথে আমিও জড়িয়ে পড়েছিলাম…গোপনে।
সময়টা ছিল মে মাসের শেষের দিক। এর আগে মারিনোর সাথে আমার কখনো কথা হয়নি…
১
নিজের হাতের দিকে তাকিয়ে সিনোহারা চিন্তা করছিল-হাত, স্তন্যপায়ী জীবের অগ্রপদের শেষ অংশ। হাতের বিকাশ হয়েছে এমনভাবে যাতে পাঁচ আঙুল দিয়ে কোন কিছু আঁকড়ে ধরতে পারে, যেমন কফি কাপ। কিংবা কিবোর্ডে টাইপ করতে পারে। ওর বিশ্বাস, মানুষের মনুষ্যত্বের পেছনে মূল অবদান এই হাতের। এজন্যই জ্যোতিষীরা হাতের রেখা পড়ার চেষ্টা করে। রেখাগুলো নাকি প্রত্যেকটা মানুষের ব্যক্তিত্ব আর ভাগ্য নির্ধারণ করে দেয়। হাত হলো অনেকটা আয়নার মত, যা দিয়ে একজন মানুষের অতীত আর ভবিষ্যৎ দেখা যায়।
ছোটবেলা থেকেই সিনোহারী হাত পছন্দ করে। হাতের প্রতি ওর আকর্ষণ এতটাই বেশি ছিল যে ওর বাবা-মা যখন ওকে বাইরে নিয়ে যেতেন, তখন ও লোকজনের মুখের দিকে তাকাত না, তাকাত তাদের হাতের দিকে। হাত যেভাবে নড়াচড়া করে তা ওকে মুগ্ধ করে। হাতের পেশি, পাঁচটা আঙুল, আঙুলের মাথার নখ, নখের মাথার নতুন চাঁদের মত সাদা অংশ-সবকিছু। আর আঙুলের ছাপ তো আছেই, যা কিনা প্রত্যেক মানুষের ক্ষেত্রে অনন্য।
এলিমেন্টারি স্কুলের ছোট ক্লাসে থাকতে সিনোহারা ওর বোনের ফেলে দেয়া পুতুলগুলোর হাত কাটতো। খেয়াল রাখত যেন কেউ আবার দেখে না ফেলে। পুতুলের ছোট ছোট হাতগুলোর নিজের হাতের তালুতে রেখে দেখত। পুতুল ফেলে দিয়ে শুধু হাতগুলো পকেটে নিয়ে ঘুরত। যখনই সুযোগ পেত ছোট ছোট হাতগুলো স্পর্শ করত পকেটে হাত দিয়ে। প্লাস্টিকের ছোট ছোট হাতগুলো ওকে যেসব গল্প বলত তা ওর মা আর শিক্ষকদের কথার চেয়ে অনেক বেশি ছিল।
এরপর ও বিড়াল আর কুকুরের সামনের পায়ের থাবা কাটা শুরু করে। গাছ ছাঁটার বড় কাঁচিগুলো থাবা কাটার জন্য চমৎকার যন্ত্র। কুকুর বিড়ালের থাবাগুলোও সিনোহারার কাছে দারুন লাগত। মানুষের হাতের তালুতে তুলতুলে প্যাড নেই, তাই ওগুলো ওর কাছে মজার মনে হতো। প্যাডে চাপ দিলে নখ বেরিয়ে আসে, ওগুলোর মধ্যে চুল জন্মায়। থাবা মানুষের হাতের মত কোন কিছু আঁকড়ে ধরতে পারে না, ওগুলোর বিকাশ হয়েছে অন্যভাবে, অন্য কারনে।
সিনোহারা ভালো করেই জানত, বেশিরভাগ মানুষ ওর এই বিশ্বাস মানতে পারবে না যে, মানুষের হাতেই তাদের মনুষ্যত্বের সৃষ্টি। ওর আশেপাশের লোকজনকে পর্যবেক্ষণ করে বুঝতে পেরেছে ও, মানুষ স্রেফ তাদের মাথা আর মুখ থেকে বের হওয়া ফালতু কথা দিয়ে চলে। আস্তে আস্তে ও যখন বড় হলো, চাকরি করা শুরু করল, নিজের চিন্তা ভাবনা নিজের ভেতর লুকিয়ে রাখতে শিখল। কিন্তু মাঝে মাঝে ও নিজেকে কেবল হাত নিয়ে চিন্তা করতে দেখতে পেত…পাঁচ আঙুলের ডিজাইন, যা কিনা কেবল ঈশ্বরের পক্ষেই তৈরি করা সম্ভব। এই চিন্তা ওর মাথা থেকে কিছুতেই বের হতে চাইত না।
তারপর এক বসন্তে ও প্রথমবারের মত একটা মানুষের হাত কাটল-একটা বাচ্চার হাত। বাচ্চাটা একটা স্ট্রলারে ঘুমাচ্ছিল। বাচ্চার মা একটু অন্যদিকে গিয়েছিল, আর ও গাছ ছাঁটার কাঁচি দিয়ে কচ করে বাচ্চাটার কব্জি থেকে হাতটা কেটে নেয়।
কী নরম আর উষ্ণ ছিল ছোট হাতটা! কাটার পর বাচ্চাটা জেগে উঠে চিৎকার করতে থাকে। সেই সাথে হাতটার উষ্ণতাও কমে যেতে থাকে। সিনোহারা বাচ্চার হাতটা পকেটে ঢুকিয়ে বাড়ি ফিরে আসে। ছোট হাতটা ওর রেফ্রিজারেটরে ভরে রাখে।
শুধু ঐ বাচ্চাটার হাতটাই একমাত্র নয়। একবার অন্ধকারের মধ্যে সিনোহারা আরেকটা শিশুকে বাড়ি দিয়ে অজ্ঞান করে তারপর তার হাত কেটে নেয়। হাই স্কুলের কিছু ছেলেপেলে আর কয়েকজন বয়স্ক মানুষের হাতও সে কেটেছে। পূর্ণ বয়স্ক মানুষের হাত বেশ মোটা হয়। গাছ ছাঁটার কাঁচি দিয়ে কচ করে কাটা সম্ভব নয়। কাটার জন্য করা খুবই কর্কশ, হাতের কাটা অংশ বিচ্ছিরি দেখাত। ব্যাপারটা সিনোহারার সৌন্দর্য বোধের সাথে একদম খাপ খেত না। কিন্তু সে তো আর হাত কাটার জন্য কাঁধে একটা কুড়াল নিয়ে ঘুরতে পারে না। শেষে মাংস কাটার চাপাতি দিয়ে কাজ চালাতে লাগল। শিকারকে অজ্ঞান করার পর ও নিখুঁত এক কোপে হাড়সহ হাত আলাদা করে ফেলত।