.
মনির আহমদ, হিমাংশু বাবুদের সঙ্গে পরিচিত হয়ে বুকের অর্ধেক বোঝা নেমে গেলো হাসিমের। এখনও পৃথিবীতে মানুষ আছে। যারা মানুষের বিত্তসম্পদের পানে তাকায় না। মানুষকে মানুষ বলেই গ্রহণ করতে পারে। কোনো রকমের বাধা বিপত্তির তোঁয়াক্কা না করে মানুষের বিপদে বুক পেতে দেবার হিম্মত রাখে। মনির আহমদ তাকে জিজ্ঞেস করলো, বাড়ি কোথায় ভাই?
জবাব দিতে গিয়ে তোতলাতে লাগলো হাসিম। তার কি বাড়ি আছে? তার কি পরিচয় আছে? এখনো কাজী বাড়ির মানুষ কণ্ঠে শ্লেষ মিশিয়ে তাকে বাঁদীর বাইচ্চা আর বান্যার পুত বলে নিন্দা করে। সুতরাং হাসিম কি বলবে? বলবে নাকি, আমি একজন ঘরহারা, সমাজহারা মানুষ। মানুষ আমাকে ঘৃণা করে, অবজ্ঞা করে– আমার জন্মের জন্য।
“খলু মিয়ার বাড়ির কাছে নাকি তোঁয়ার বাড়ি?” (খলু মিয়ার বাড়ির কাছে নাকি তোমার বাড়ি?) জিজ্ঞেস করে মনির আহমদ।
“জ্বী, একটু পুব সাইডে, পইরের উতর পাড়ে।” (হ, একটু পুব পাশে, পুকুরটার উত্তর পাড়ে।)
“কি নাম তোঁয়ার ভাই?” (কি নাম তোমার ভাই?)
“আবুল হাসিম, মাইনসে হাসিম ডাকে।” (আবুল হাসিম, মানুষে ডাকে হাসিম।)।
তা ছাড়া, মানুষ আরো নামে তাকে ডাকে। সে কথা মনির আহমদকে জানাতে বড় সাধ হলো। কিন্তু পারলো না। জিহ্বাটা আটকে রইলো।
“ঠিক আছে, আঁরা তোঁয়ারের হাসিম বুলি ডাইকাম।” (ঠিক আছে, আমরা তোমাকে হাসিম বলে ডাকবো।) বললো হিমাংশু বাবু।
হাসিমের মনে হলো এতোদিনে পৃথিবীতে তার আসল পরিচয় দিতে পেরেছে। সে এখন অনেক সুখী। মনির আহমদের কণ্ঠস্বর তার বুকের অর্ধেক জ্বালা শুষে নিয়েছে। হিমাংশুবাবু তাকে বললোঃ
“হাসিম বাই, তোঁয়ার যদি কাজ কাম কম থাহে আঁরার লগে কদিন আইও না। চৌকেত দেখর কি রকমের কি রকমের বিপদ।” (হাসিম ভাই, তোমার যদি কাজ কর্ম কম থাকে আমাদের সঙ্গে এসো না। দেখতে তো পাচ্ছো চোখে কি ধরনের বিপদ।)
এমনি একটা আমন্ত্রণের জন্য হাসিম যেন সারাজীবন অপেক্ষা করেছিলো। তবু ঝটপট কিছু বলতে পারলো না। সুফিয়ার কথা মনে হলো। সে যদি সমিতির লোকদের সঙ্গে ঘুরে বেড়ায়, কি খাবে? কি ভাবে চলবে তার দিন? হাসিম ভাবতে থাকে। ভেবে কোনো কুল-কিনারা করতে পারে না। অধোমুখে দাঁড়িয়ে থাকে।
মনির আহমদ আবার সস্নেহে জিজ্ঞেস করেঃ
“কি ভাবদে?” (কি ভাবছো?)
“জ্বী,” হাসিম পেঁচার মতো চোখ গোল গোল করে চেয়ে থাকে।
“বাড়িতে কন আছে তোঁয়ার হাসিম ভাই?” (বাড়িতে কে আছে তোমার হাসিম ভাই?)।
হাসিম বড় ফাঁপরে পড়লো। কেমন করে বলবে তার একটা বৌ আছে। বৌয়ের পেটে আবার বাচ্চা আছে। তাকে ভাত খেতে হয়। এতো বড়ো লজ্জার কথাটা সে কেমন করে নিজের মুখে উচ্চারণ করবে?
“আগে কি কাম গইরতা হাসিম বাই?” (আগে কি কাজ করতে তুমি হাসিম ভাই?) শুধায় মনির আহমদ।
“জ্বী, পাহাড়ত যাইতাম।” (পাহাড়ে যেতাম।)
“বাড়িঘরের কথা এই কদিন তোঁয়ার ভাবন ন পড়িব, সমিতির থুন চাঁদা গরি চালাইয়াম।” (বাড়িঘরের কথা ক’দিন তোমাকে ভাবতে হবে না। সমিতি থেকে চাঁদা করে চালাবো।)
অবাক হয়ে যায় হাসিম। জগতে এমন মানুষও কি আছে! তার মতো মানুষকেও বুকে টেনে নিতে দ্বিধা করে না! তার বুকে খুশি উপচে পড়তে চায়। হাজেরা চিৎকার করে কাঁদছে। সে কান্না হাসিমের কানে ঢুকছে না। অপরাহ্নের মিঠে মিঠে সোনালী রোদের দিকে চেয়ে একটা বিচিত্র সুর শুনতে পায়। মনির আহমদ বললোঃ
“বড়ো স্কুলের মাডত আগামী রবিবারে আঁয়ারার সমিতির মিটিং অইবো। অনেক নেতা আইব। তুইও আইবা তোঁয়ার চেনা-জানা মইনসরে লই।” (বড় স্কুলের মাঠে আমাদের সমিতির সভা হবে। অনেক নেতা আসবে। তুমিও তোমার চেনা-জানা মানুষদের নিয়ে আসবে।) হাসিম ঘার নেড়ে সায় দিলো।
অনেক নেতা এসেছে। আগে মিটিংও করেছে। বড় স্কুলের মাঠও গরম করেছে। তার মতো ছোটলোকের তো ডাক পরে নি। তৎক্ষণাৎ ঠিক করে ফেললো চন্দ্রকান্ত চাচাকে নিয়ে যাবেই যাবে।
রোববার সকালবেলা হাসিম হাইস্কুলের মাঠে গেলো। যাবার সময় চন্দ্রকান্তকেও সঙ্গে করে নিয়ে গেলো। সমিতির লোকেরা বক্তৃতার প্যাণ্ডেল তৈরি করছে। মাঠের মধ্যে নানারকম প্ল্যাকার্ড পুঁতে রেখেছে। বড় বড় কি যেন লেখা লাল কালিতে। ওখানে নাকি কলেরা মহামারীর প্রতিকারের দাবী, খাবার জিনিসের দাম কমাবার দাবী লেখা আছে। কেউ কারো ওপর খবরদারী করছে না। কেমন নীরবে সুশৃঙ্খলভাবে কাজ করছে। মনির আহমদের ফুরসত নেই। এমন সকালবেলাতেও ঘেমে নেয়ে উঠেছে। কণা কণা ঘামের ওপর সূর্যালোক চিক চিক করে জ্বলছে। মনির আহমদকে আজ আশ্চর্য তেজোব্যঞ্জক দেখাচ্ছে। বেঁটেখাটো মানুষটা। সারা শরীরে অসাধারণ কিছু নেই। কিন্তু চোখ দুটোর দিকে চাওয়া যায় না। বাজপাখির কথা মনে পড়লো হাসিমের। মুখের দিকে চেয়ে বুকের কথা বলে দিতে পারে। তেমনি অন্তর্ভেদী তীক্ষ্ণ গভীর চাউনি।
চারদিকে নতুন পরিবেশ। দেখেশুনে চন্দ্ৰকান্তের চোখ তো চড়কগাছ। চাড়া দিয়ে ওঠে কৌতুকবোধঃ
“জয় রাধামাধব, কড়ে আনলি ভাইপুত?” (জয় রাধামাধব, কোথায় নিয়ে এলি ভাইপো?) রাধামাধবের উদ্দেশ্যে দু’হাত জোড় করে প্রণাম করে হাসতে থাকে। বিরাট কোদাল কোদাল দাঁতগুলো হাসির তোড়ে বেড়িয়ে পড়ে।
মনির আহমদ নীরবে এসে হাসিমের মাথায় হাত রাখে।