মাতব্বর বাহুমূলে একটি পট্টি জড়িয়ে সিন্দুক খুলে টাকা নিলো। তারপর ছদুসহ অন্যান্য আহতদের নিয়ে ছুটলো৷ এজাহার করার পর অন্যান্য আহতদের থানা হাসপাতালে পাঠিয়ে দিলো।
দু’পক্ষ এজাহার করেছে। সন্ধ্যার দিকে গ্রামে পুলিশ এলো। মনে মনে মাতব্বর বেজায় খুশি হয়েছে। তার পক্ষের মানুষেরা জখম হয়েছে বেশি। কারো কারো অবস্থা সঙ্কটজনক। সুতরাং মামলা তার পক্ষে যাবে। এখন চেয়ারম্যান সাবকে খবর দিয়ে বড়ো দারোগাকে সন্তুষ্ট করতে পারলেই হলো। একটু পরেই বাঁকা লাঠিটা হাতে নিয়ে চেয়ারম্যান সাব এলো। ইজিচেয়ারে হেলান দিয়ে বসে পা নাচাচ্ছে দারোগা। পাশে একখানা টিনের চেয়ার টেনে নিয়ে চেয়ারম্যান কানা আফজল বসলো। দারোগার সঙ্গে অনেকক্ষণ ধরে ফিসফাস আলাপ করলো। খলুকে ডেকেও কানে কি বলে দিলো।
সন্ধ্যা হয়ে এলো। চেয়ারম্যান সা’ব চলে গেলো। খলু জোড়হাতে চেয়ারম্যান সা’বকে, দারোগা-পুলিশদের সঙ্গে দু’মুঠো খেয়ে যেতে অনুরোধ করলো। এর প্রতিক্রিয়া ভালো হবে না সে কথা চেয়ারম্যান সাব খুলুর কাছে ব্যাখ্যা করলো। ঘরের খাসী জবাই করে দারোগা-পুলিশকে আচ্ছা করে খাওয়ালো। রাতের বেলায় আসামী ধরার জন্য পুলিশেরা সাতবাড়িয়া চলে গেলো।
মাতব্বরকে নানা দিক দেখতে হয়। বড়ড়া সঙ্কটের সময় এখন। কামলারাও পালিয়েছে। দারোগা-পুলিশকে খুব ভয় করে কিনা। খলুরও ভয় করে প্রবলভাবে। তবু একবার যখন ফেঁসে গেছে আর রক্ষে নেই। একটু আগে চেয়ারম্যান সা’ব যে কথা বলে গেছে তার তাপে খলুর মতো মানুষের শরীরেও বিন্দু বিন্দু ঘামের কণা নির্গত হয়েছে।
দারোগা-পুলিশকে খাওয়াতে হয়, টাকা দিতে হয়, এতোদিন তা-ই জানতো খলু। রাতের শয্যার সঙ্গীনীও যে তাদেরকে দিতে হয় এ জ্ঞান খলুর ছিলো না। খলু ভাবছে আর চর্বিওয়ালা পাহাড়ের মতো সটান শুয়ে থাকা মানুষটাকে হাওয়া করেছে। ভাবছে, কি করা যায়। শহর-বন্দর নিদেন পক্ষে থানা হলেও বিশেষ অসুবিধে ছিলো না। এ যে নিতান্তই গণ্ডগ্রাম। কোথায় পাবে নষ্টা মেয়েমানুষ? টাকা দিলেও কে আসবে? প্রত্যেকটা মুহূর্ত তার স্নায়ুকেন্দ্রে হাতুড়ির ঘায়ের মতো বেজে উঠছে প্রবলভাবে। খলুর মতো অমন শক্ত-সমর্থ কূট-কৌশলী মানুষও ছিন্নভিন্ন হয়ে যাচ্ছে। দারোগার মুখোমুখী দাঁড়িয়ে কিরূপে না বলবে– বিশেষ করে এ বিপদের সময়।
দারোগা বোঁজা চোখ দুটো পাকিয়ে প্রকাণ্ড একটা কাতলা মাছের মতোই হাই তুললো। চারদিকে স্থির দৃষ্টিতে চেয়ে জিজ্ঞেস করলোঃ
“চেয়ারম্যান সা’ব তোমাকে কিছু কন নি?”
“জী হুজুর, কইয়ে।” (হ্যাঁ হুজুর, বলেছে।) কুণ্ঠিতভাবে জবাব দিলো খলু।
“যাও, তোমার পাখা করতে হবে না। অন্য কাউকে ডেকে দাও, পাখা করুক।”
“এ্যাই শোন্।” খলু নতমুখে ঘরে ঢুকলো।
“হুজুর।”
“ডাবকা জোয়ান মাংসল আর পুরুষ্ট বুক দেখে আনবে। যাও তাড়াতাড়ি।”
আর কাউকে না পেয়ে হাসিমকে ঘর থেকে গিয়ে নিয়ে আসে। হাসিম আনমনে পাখা করছে। তালের পাখার নরম হাওয়া ছুটছে। শব্দ উঠছে। বাইরে লুটিয়ে পড়ছে চাঁদের আলো। এ আলোতে কতো কথা মনে পড়ে। দারোগা সা’ব হাতির মতো মোটা ডান পা-খানা প্রসারিত করে দিয়ে বললোঃ
“এ্যাই একটু টিপে দে তো।”
ঘৃণায় কুঞ্চিত হয়ে ওঠে হাসিমের নাক-মুখ। তবু পা টিপতে হয়। না টিপে যে উপায় নেই। বৈঠকখানার জানালা দিয়ে হাসিম দেখতে পেলো মাতব্বর কাকে ধাক্কিয়ে ধাক্কিয়ে এদিকে নিয়ে আসছে। নিয়ে আসছে সেটি মেয়ে। অবাক হয়ে দেখতে লাগলো হাসিম। আপনা থেকেই পা টেপা বন্ধ হয়ে গেলো। চিনতে চেষ্টা করলো। দারোগা ঝাঁজালো গলায় বললোঃ
“এই শালার বেটা থামলি কেন?”
হাসিম ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায়। খলু চোরের মতো ঘরে ঢুকে হাসিমকে বললোঃ
“হাসিম, তুই এহন যা।”
হাসিম বেড়িয়ে আমগাছটার কোলভরা অন্ধকারের ভেতর আত্মগোপন করে রইলো। দেখলো, জোহরাকে জোরে ধাক্কিয়ে ধাক্কিয়ে দরজার কাছ অবধি নিয়ে যাচ্ছে খলু। কাঁদছে জোহরা। কাঁদবার পালাই তো তার এখন। খলু তাকে ঘরের ভেতর ঢুকিয়ে বাইরে থেকে শেকল তুলে দিলো। এমনও হয়? এমন ও হয়? চিন্তা করতে পারে না হাসিম। আপন চাচা নিজের ভাইয়ের মেয়েকে জোরে-জব্বরে দারোগার কাছে ঠেলে দিতে পারে? হাসিম কি দেখছে? পৃথিবীটা কাঁপছে কেন? আকাশ-বাতাস টলছে কেন? বোধশক্তি সে হারিয়ে ফেলেছে। নিশ্চল পাথরের মূর্তির মতো নিশ্চেষ্টভাবে দাঁড়িয়ে থাকলো। তার দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থাতেই আধখানা সোনার থালার মতো সুন্দর চাঁদ ডুবে গেলো। চরাচরের জীবন্ত পীচের মতো অন্ধকার। হেঁটে আসছে কে একজন। সেদিকে এগিয়ে গেলো হাসিম। তাকে দেখে হেঁটে আসা মূর্তি থমকে দাঁড়ায়। হাসিম জিজ্ঞেস করে। কিন্তু ফ্যাসফ্যাসে গলার স্বর বেরোয় না।
“হেইভা কন?” (তুমি কে?) ছায়ামূৰ্তি কথা কয় না। এগিয়ে আসে। কেঁপে কেঁপে হাসিমের হাত ধরে। জড়িয়ে ধরে কাঁপতে থাকে। হাসিমও কাঁপে। কেন কাঁপে? জোহরা সংজ্ঞা হারিয়ে হাসিমের গায়ে ঢলে পড়ে। অন্ধকারের নির্মম চক্রান্ত চারদিকে। এ অন্ধকারেই ঢলে পড়লো নির্মমভাবে ধর্ষিতা জোহরা।
৪. অভিজ্ঞতার বাড়া শিক্ষা নেই
অভিজ্ঞতার বাড়া শিক্ষা নেই। দিনে দিনে হাসিমের অভিজ্ঞতার ভাণ্ড সমৃদ্ধতরো হচ্ছে। বিগত পঁচিশ বছরের জীবনখানা অনুজ্জ্বল মিনারের মতো ঠেকে। এতোদিন পেছনের দিকে তাকিয়ে দেখতে অভ্যস্ত ছিলো না। হঠাৎ অনেকগুলো ঘটনার আকস্মিক আলোকসম্পাতে তার দৃষ্টিশক্তিতে অনেক তীক্ষ্ণতা এসে গেছে। জীবনের একটা অর্থ ধীরে ধীরে রূপময় হয়ে তার চোখে জেগে উঠেছে। সমাজের প্রত্যেকটি মানুষের আচার-আচরণের অন্তরালে যে মহাসত্য সক্রিয় হাসিমের চেতনায় তা দৃশ্যমান হয়ে ওঠে দিনে দিনে। হাসিম অহরহ দগ্ধ হয়। বুকের চিন্তার আগ্নেয় রশ্মি মাঝে মাঝে বিদ্যুতের মতো ঝলসে ওঠে। সে আলোকে জগত জীবনের সমস্ত রহস্যকে বিচার করা যায়, বিশ্লেষণ করা যায়। মানুষ তাকে অবজ্ঞা করে কেন? কেন ঘৃণা করে? হাসিমের ধারণা তার কেন্দ্রবিন্দুটিতে হাত দিতে পেরেছে সে। সে এক নিষ্ঠুর সর্বভূক অনল। রাতদিন দগ্ধ হয়, মুখ ফুটে রা করার উপায় নেই। হাসিমের বাপ গ্রামের মধ্যে একমাত্র মানুষ যার কাছে এ মহাসত্য উলঙ্গভাবে উদ্ঘাটিত হয়েছিলো। মুখ ফুটে একবার উঁহু শব্দটিও উচ্চারণ করে নি। নীরবে নীরবে হৃদয়ের সে কি বেদনার্ত রক্তক্ষরণ! অনুমান করতে কষ্ট হয় না হাসিমের, যার বুকে যত বেশি বৎসব বেদনার সে ততো বেশি চিত্তাকর্ষক গল্প-কাহিনী রচনা করতে পারে। সামাজিক সত্যের আগুন পলে পলে দগ্ধ করেছিলো বলে তার বাপ হামেশা বেহেস্তের দোহাই দিতো। কল্পনাকে স্বর্গরাজ্যে তুলে দিয়ে কেমন আত্মপ্রবঞ্চনা করতো। রহমত কাজীর মেয়ে জরীনার আকর্ষণে বাপের ধর্ম ছেড়ে মুসলমান হয়েছিলো। মুসলমান হলেও জরীনাকে পায় নি। সেখানেই তার বাপের সবচেয়ে বেশি দুঃখ, চিত্তক্ষোভ, ব্যর্থতা। নিজের ব্যর্থতা চাপা দেবার জন্যে বুড়ো যখন তখন বেহেস্তের কথা বলতো। ধর্ম কি? এ সকল প্রশ্ন জাগে হাসিমের মনে। তার বাপ ভুল করেছিলো, বিরাট ভুল। জীবনের চাইতে প্রেম বড়ো নয়। প্রেমকে দেখেছিলো, জীবনকে নয়। জানতো না তার বাপ। জীবনের চাইতে প্রেম বড়ো নয়। প্রবল প্রেমের আকর্ষণে পরিচিত সমাজের গণ্ডী পেরিয়ে আরেকটা অনাত্মীয় সমাজের পরিবেশে এসে দেখলো ঘাসের ডগায় সূর্যালোক ঝলমল করা শিশির বিন্দুটি যার নাম প্রেম, কখন শুকিয়ে গেছে। রইলো শুধু আগুনভরা আকাশ। সে আগুনের শিখাহীন নির্দয় দহনে সারাটি জীবন জ্বলে পুড়ে মরলো। হাসিমের চেতনার আকাশে এ সকল প্রশ্ন বিজুলীর ফুলের মতো জেগে ওঠে। উল্কার মতো ভস্ম হয়ে যায়। অন্তরের অন্বিষ্ট চেতনার আলোকে চারপাশের কঠিন বাস্তবকে আরো নিখুঁতভাবে দেখতে পায়। একনিষ্ঠ স্রোতের মতো একমুখী জীবন হাসিমের। বাইরে জগতের কোনো সংঘাত লাগলে এসকল চিন্তা মনের অন্ধকার নিশুতির রাজ্যে নক্ষত্রমালার মতো জ্বলে ওঠে। চিন্তার আলোকে অনেক ডুবো পাহাড়কে দেখে–যে সকল পাহাড়ের সঙ্গে ধাক্কা লেগে সমস্ত জীবন স্থবির নিশ্চল হয়ে যায়।