প্রফেসর আবদুর রাজ্জাকের সঙ্গে পরিচিত হওয়া আমার জীবনের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাসমূহের একটি। দৃষ্টিভঙ্গির স্বচ্ছতা নির্মাণে, নিষ্কাম জ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রে, প্রচলিত জনমত উপেক্ষা করে নিজের বিশ্বাসের প্রতি স্থিত থাকার ব্যাপারে প্রফেসর আবদুর রাজ্জাকের মতো আমাকে অন্য কোনো জীবিত বা মৃত মানুষ অতোটা প্রভাবিত করতে পারেনি। প্রফেসর রাজ্জাকের সান্নিধ্যে আসতে পারার কারণে আমার ভাবনার পরিমণ্ডল বিস্তৃততর হয়েছে, মানসজীবন ঋদ্ধ এবং সমৃদ্ধতিরো হয়েছে। আমি যদি বসওয়েলের মতো পরিপাটি স্বভাবের মানুষ হতাম, কিংবা একারমানের মতো শৃঙ্খলা নিষ্ঠ আনুগত্য আমার থাকত, বসওয়েল যেভাবে জনসনের একটি বিশ্বাসযোগ্য চরিত্র সকলের সামনে তুলে ধরতে পেরেছেন, অথবা একারমান যেরকম অখণ্ড বিশ্বস্ততা সহকারে দিন তারিখ প্রহর উল্লেখ করে মহাকবি গ্যোতের কথোপকথন লিপিবদ্ধ করে রেখে গেছেন, সে ধরনের একটা গ্রন্থ প্রফেসর রাজাকের ওপর রচনা করা হয়তো আমার পক্ষে অসম্ভব হত না। আমি গল্প কবিতা উপন্যাস এসকল জিনিস লিখে থাকি এবং লিখে আনন্দ পেয়ে থাকি। সৃষ্টিশীল মানুষেরা সাধারণত বিপজ্জনক ধরনের হয়ে থাকেন। বাইরে তারা যতোই নিরীহ এবং অপরের প্রতি মনোযোগী হয়ে থাকুন না কেনো ভেতরে তাদের স্বেচ্ছাচারী হওয়া ছাড়া উপায় থাকে না। যেখানে আত্মপ্রকাশের বিষয়টি অপর সকল কিছুকে ছাপিয়ে ওঠে, সেখানে ব্যক্তিকে অনিবাৰ্যভাবে স্বেচ্ছাচারী হয়ে উঠতে হয়। সৃষ্টিধর্মের নিয়ম ছাড়া বাইরের কোনো নিয়ম সেখানে ক্রিয়াশীল হয়ে উঠতে পারে না।
উনিশশো বাহাত্তর সাল থেকে শুরু করে উনিশশো চুরাশি সালের মাঝামাঝি পর্যন্ত প্রায় এক যুগ সময়ের সবটাই কম করে হলেও অন্তত সপ্তাহে একবার প্রফেসর রাজ্জাকের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছি। নানা বিষয়ে তার বক্তব্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা মুগ্ধ হয়ে শুনেছি। ধর্ম, সমাজ, রাষ্ট্র ইত্যাকার বিষয়ের ওপর যেসকল কথা স্বতঃস্ফূর্তভাবে তিনি বলে গেছেন, সেগুলো যদি দিন তারিখ উল্লেখ করে যথাযথভাবে টুকে রাখতে পারতাম, আমি আমার দেশের মানুষের সামনে জ্ঞানবিজ্ঞানের একটা রত্নভাণ্ডারের পরিচয় তুলে ধরতে পারতাম। এই রচনার পরবর্তী অংশে আমি সেসকল কথাই বলবো, যেগুলো অদ্যাবধি আমার পক্ষে ভুলে যাওয়া সম্ভব হয়নি। আমার দ্বিধা এবং শঙ্কার পরিমাণও সামান্য নয়। প্রফেসর রাজ্জাক যে স্পিরিটে কথা বলেছেন আমার উপস্থাপনায় সে জিনিসটি অবিকৃতভাবে রক্ষিত হয়েছে এমন দাবি করাও আমার পক্ষে সম্ভব নয়। শোনা কথা স্মৃতি থেকে উদ্ধার করে উপস্থাপন করার বেলায় মূলের অনেক কিছুই হারিয়ে যেতে পারে। আমার ক্ষেত্রেও সেটি যে ঘটেনি এমন কথা আমি বলতে পারবো না।
বিগত অর্ধশতাব্দীরও অধিক সময় ধরে আমাদের দেশের কৃতবিদ্য ব্যক্তিদের একটা বিরাট অংশ প্রফেসর রাজাকের সংস্পর্শে এসেছেন। তারা বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজসমূহ, আমলাতন্ত্র, রাজনীতি এবং আইন ইত্যাকার নানা পেশার মধ্যে ছড়িয়ে রয়েছেন। তাদের একাংশ মারা গেছেন। তা সত্ত্বেও একটা বিরাট অংশ অদ্যাবধি জীবিত আছেন। তাদের মধ্যে এমন অনেক ব্যক্তি রয়েছেন, যারা প্রফেসর রাজ্জাকের সংস্পর্শে এসেছেন। তার পাণ্ডিত্যের চুম্বকের মতো একটা আকর্ষণী শক্তি অবশ্যই আছে। বিদেশের অনেক বিদগ্ধ ব্যক্তিও নানা সময়ে প্রফেসর রাজ্জাকের ব্যক্তিত্বের সম্মোহনে তার প্রতি আকৃষ্ট হয়েছেন। পরবর্তী জীবনে তাদের কেউ-কেউ বিশ্বব্যাপী খ্যাতি এবং পরিচিতির অধিকারী হয়েছেন। সে তুলনায় আমি নিতান্তই সামান্য মানুষ। প্রফেসর রাজ্জাকের একনিষ্ঠ ভক্ত অগ্রজপ্রতিম অধ্যাপক সরদার ফজলুল করিম তাঁর সঙ্গে আলাপচারিতার ভিত্তিতে যে অসাধারণ গ্রন্থটি রচনা করেছেন সেরকম যোগ্যতা, একাগ্রতা এবং বিষয়নিষ্ঠা আমি কোথায় পাবো? আমি এই রচনার পরবর্তী অংশে প্রফেসর রাজ্জাককে উপলক্ষ করে যেসকল কথা বলছি, তার মধ্যে প্রফেসর রাজ্জাক কতটুকু আছেন, আমি কতটুকু, ভেদরেখাটি আমার কাছেও স্পষ্ট নয়। মোটের ওপর এ রচনাটি দাড়াচ্ছে মহাকবি আলাওলের ভাষায়—“গুরু, মুহম্মদে করি ভক্তি, স্থানে স্থানে প্রকাশিব নিজ মনোউক্তি” অনেকটা এরকম।
আমি বন্ধুবান্ধবদের কাছে একজন জ্ঞানী শিক্ষকের নাম জানতে চেয়েছিলাম, র্যাকে আমার পিএইচডি থিসিসটির পরামর্শক হিসেবে বেছে নিতে পারি। সকলে আমাকে বললেন তুমি রাজ্জাক সাহেবের কাছে যাও। তার মতো পণ্ডিত আর একজনও নেই। সে সময়ে প্রাইভেট পরীক্ষার্থী হিসেবে পলিটিক্যাল সায়েন্সে পরীক্ষা দিচ্ছিলাম। বিশ্ববিদ্যালয়ে আমি বাংলা বিভাগের ছাত্র ছিলাম। সুতরাং বাংলা বিভাগের বাইরে অন্যান্য বিভাগের শিক্ষকদের মধ্যে মাত্র দুয়েকজনকে চিনতাম। পলিটিক্যাল সায়েন্সের ম্যাক মানে মোজাফফর আহমদ চৌধুরী সাহেবকে দূর থেকে দেখেছি। আবদুর রাজ্জাক নামের একজন শিক্ষক আছেন জানতে পারলাম, যখন আমার পিএইচডি থিসিসের একজন সুপারভাইজার বেছে নেয়ার কথা উঠল।
আমি স্থির করলাম একদিন রাজ্জাক সাহেবের বাড়িতে গিয়ে আমার থিসিসের সুপারভাইজার হওয়ার অনুরোধটা করবো। বন্ধুবান্ধবেরা আমাকে এ মৰ্মে হুশিয়ার করে দিল যে রাজ্জাক সাহেব ভীষণ নাকউচু স্বভাবের মানুষ। বাঘা বাঘা লোকেরাও তাঁর কাছে ঘেঁষতে ভীষণ ভয় করেন। সুতরাং কথাবার্তা সাবধানে বলবে। যদি তার অপছন্দ হয়, পত্রপাঠ দরোজা দেখিয়ে দেবেন। অনেক দ্বিধা, অনেক শঙ্কা এবং সঙ্কোচ নিয়ে একদিন বিকেলবেলা প্রফেসর রাজ্জাকের বাড়িতে গেলাম। তখন তিনি শহীদ মিনারের বিপরীতে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকদের কোয়ার্টারের একটিতে নিচের তলায় থাকতেন। দরোজা আধভেজানো অবস্থায় ছিল। আমি খানিকক্ষণ ইতস্ততা করছিলাম। যদি দরোজা ঠেলে সোজা ঢুকে পড়ি কেমন দেখাবে? মনে তো শঙ্কা ছিলোই। কোনো আচরণ যদি বেয়াদবি ঠেকে? বেশ কিছু সময় অপেক্ষা করার পরও কাউকে না পেয়ে আমি ভয়ে ভয়ে দরোজা ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করলাম।