রাজ্জাক সাহেব একটা বিশেষ যুগ, বিশেষ সময়ের মানুষ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠার দ্বিতীয় দশকের দিকে রাজ্জাক সাহেব ছিলেন ছাত্র এবং তৃতীয় দশকে শিক্ষক হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেন। এই রচনায় অন্তত এক জায়গায় উল্লেখ করা হয়েছে যে এই অঞ্চলের জনগোষ্ঠীর তিনটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ওতপ্রোতভাবে জড়িত। তার একটি পাকিস্তান আন্দোলন, অন্যটি ভাষা আন্দোলন এবং পরেরটি বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রাম। রাজ্জাক সাহেবের জীবন ওই তিনটি ঘটনার মধ্য দিয়েই প্রবাহিত হয়েছে। এই অঞ্চলের জনগোষ্ঠীর ঐতিহাসিক অহংবোধ এই তিনটি ঘটনায় তিনবার তিনভাবে আত্মপ্রকাশ করেছে। একটার সঙ্গে আরেকটার বহিরঙ্গের দিক দিয়ে পার্থক্য থাকলেও একটা মূলগত ঐক্যের কথা কিছুতেই অস্বীকার করার উপায় নেই। রাজ্জাক সাহেবকে বাঙালি মুসলমানসমাজের ঐতিহাসিক হংবোধের প্রতীক বললে অধিক হবে না। তথাপি তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি সনাতন মুসলিম লীগপন্থীদের সঙ্গে পুরোপুরি এক না হলেও সর্বাংশে উদার একথা মানতে অন্তত আমার বাধবো। উনিশশো তিরিশ সালের পর যে বুদ্ধিজীবী শ্ৰেণীটি বাংলার মুসলমানের আশা-আকাঙক্ষার ধারক বাহক হয়ে উঠেছিল, রাজ্জাক সাহেব ছিলেন তাদের মধ্যে সবচাইতে শানিতাদের মধ্যে বিশিষ্ট একজন। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর যে-সমস্ত বুদ্ধিজীবী বাংলাদেশের জন্ম-প্রক্রিয়ায় নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, রাজ্জাক সাহেব তাতে একটি অত্যন্ত বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেছেন। তার চরিত্রের একরৈখিকতা, অনাপোসি মনোভঙ্গি এবং একান্ত মুসলিমসমাজভিত্তিক ধ্যান-ধারণার মধ্যে একটা প্রবণতা অনায়াসে লক্ষ করা যাবে, সেগুলো যতোটা নিরপেক্ষ ইতিহাস অনুধ্যানের ফল ততটা হিন্দুসমাজের প্রতিক্রিয়াসঞ্জাত অভিব্যক্তি। যে সময়ে, যে সমাজে তিনি জন্মগ্রহণ করেছেন, যে সাংস্কৃতিক রাজনৈতিক পরিমণ্ডলের মধ্যে তিনি বেড়ে উঠেছেন, তার প্রভাব পুরোপুরি অতিক্রম করা তার পক্ষে সম্ভব হয়নি। তথাপি ভাবতে অবাক লাগে তিনি যে প্রজন্মের মানুষ, সেই প্রজন্মকে কতদূর পেছনে ফেলে এসেছেন। পরবর্তী অনেকগুলো প্রজন্মকে বুদ্ধিবৃত্তি এবং মানসকর্ষণের দীক্ষা দিয়েছেন। বলতে গেলে কিছুই না লিখে শুধুমাত্র সাহচৰ্য, সংস্পর্শের মাধ্যমে কত কত আকৰ্ষিত তরুণচিত্তের মধ্যে প্রশ্নশীলতার অন্ধুর জাগিয়ে তুলেছেন, একথা যখন ভাবি বিস্ময়ে অভিভূত না হয়ে উপায় থাকে না।