আমি কথা প্রসঙ্গে জানালাম, আলাউদ্দিন খান সাহেবের ওপর একটি উপন্যাস লেখার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। স্যার বললেন, আলাউদ্দিন খান একজন ঋষিতুল্য মানুষ আছিলেন। আপনে চেষ্টা করলে লিখতে পারবেন। আলাউদ্দিন খান সাহেব এমনিতে বিনয়ী মানুষ আছিলেন, কিন্তু একবার চটলে আর রক্ষা আছিল না। ক্ষীতিমোহন সেনের সঙ্গে খান সাহেবের একটা বিষয়ে মিল আছে। রাইগ্যা গেলে দুইজনই ভয়ানক অইয়া উঠতেন। রবীন্দ্রনাথ ক্ষীতিমোহনবাবুরে অনেক খোসামোদ কইর্যা শান্তিনিকেতনে রাখছিলেন। ক্ষীতিমোহনবাবু ছাড়া আর সকল মানুষরে রবীন্দ্রনাথ তুমি সম্বোধন করতেন। কিন্তু ক্ষীতিমোহনকে রবীন্দ্রনাথ আপনি সম্বোধন করতেন। ক্ষীতিমোহনবাবুও রাইগ্যা গেলে প্রচণ্ড অইয়া উঠতেন। আশু সেন আছিলেন ক্ষতিমোহনবাবুর জামাই। যখন জানতে পারলেন, আগে আশুবাবু আরেকটা মেমসাহেব বিয়া করছিলেন, ক্ষীতিমোহনবাবু জামাইরে খুন করবার লইছিল। কিছুদিন আগে দেশ পত্রিকা ক্ষীতিমোহন সেনের চিঠিপত্র ছাপাইছে দেখছেন নিহি? পড়লে বুঝতে পারবেন মানুষটা কেমন আছিল।
আমি বললাম, ক্ষীতিমোহন সেনের ‘কবীর’, ‘চিন্ময়বণবঙ্গ’, ‘ভারতবর্ষের হিন্দু মুসলমানের যুক্ত সাধনা’ এসব বই আমি পড়েছি।
স্যার বললেন, বই পড়ে ক্ষীতিমোহন সেনের সবটা জানা যাইব না। চিঠিপত্রের মধ্যেই মানুষটার আসল পরিচয় পাওন যায় বেশি। স্যার বলতে থাকলেন, আমি যত অসাম্প্রদায়িক মানুষ দেখছি ক্ষিতিমোহনবাবু এবং তার জামাই আশুবাবুর মতো আর কাউরে দেখি নাই। আশু সেন আছিলেন হাইকোর্টের জজ। পরে ঢাকা য়্যুনিভার্সিটির ট্রেজাররি অইছিলেন। এখন যে নোবেল প্রাইজ ধরি-ধরি করতাছেন অমত্য সেন, আশু সেন আছিলেন তাঁর বাবা। অমত্য অইল গিয়া ক্ষীতিমোহন সেনের নাতি। বিক্রমপুরের খাঁটি বাঙাল।
রাজ্জাক সার অত্যন্ত তাজিম সহকারে কাজী মোতাহার হোসেনের কথা স্মরণ করলেন। লেকচারার হিসেবে মাইনা পাইতেন একশো বিশ টাকা। রিডার হিসেবে রিটায়ার করার সময়ও কত পাইতেন, তিনশো টাকার বেশি না। এ নিয়া তারে কেউ কোনোদিন কথা বলতে শুনে নাই। ইংরেজি বাংলা দুইডা ভাষাতে সুন্দরভাবে পড়াইবার পারতেন। হরিদাস ভট্টাচার্য ফিলসফির মাস্টার আছিলেন। অগাধ পাণ্ডিত্য! তাঁরাও টাকাপয়সার দিকে নজর আছিল না। মাঝে মাঝে হুমায়ূন কবির ভাইভা নিতে অইলে তার বাড়িতে থাকতেন। হরিদাসবাবুরে জর্জ দ্যা ফিফথ লেকচার দিবার জন্য ডাকা অইল। তাঁর আগে এই লেকচার দিছিলেন অলডাস হাক্সলি। এ্যালডাস হাসিকলির কথা সকলে কয়, হরিদাস বাবুরে মনে রাখছে কয় জন।
আমি ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর কথা ওঠালাম।
রাজ্জাক স্যার বললেন, শহীদুল্লাহ সাহেব যে বিষয়ে পিএইচডি করছিলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন ইংরেজ ভাইস চ্যাঞ্চেলর মনে করতেন, শহীদুল্লাহ সাহেবের সে বিষয়ে কাজ করার যোগ্যতা আছিল না।
আমি ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর অন্যবিধ কীর্তির প্রতি স্যারের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চেষ্টা করলাম, দেখলাম তিনি সে বিষয়ে বিশেষ আগ্রহী নন।
আমরা ওঠবার চেষ্টা করছিলাম। স্যার অনেক কথা বলে ফেলেছেন। এরই মধ্যে তিনি ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন। টের পাচ্ছিলাম, কথা বলতে তাঁর হাফ ধরে যাচ্ছে। আমাদের খারাপ লাগছিল। আমরা তাকে কষ্ট দিচ্ছি। কিন্তু শেষ মুহুর্তে স্যার আবার মুনীর চৌধুরীর কথা ওঠালেন।
১৬. ঢাকার পোলা
ইংরেজ কবি শেকসপীয়র বলতে গেলে বেবাক জীবনটা লন্ডনে কাটিয়েছিলেন। তবু তাকে অ্যাবন নদীর পাড়ের ছাওয়াল বলতে অনেকে কুণ্ঠাবোধ করেননি। জার্মান কবি গ্যোতে তিরিশের কোঠায় পা রাখার সময়ে জন্মভূমি ফ্রাঙ্কফুর্ট ছেড়ে ভাইমারে চলে গিয়েছিলেন। তাঁর বিরাশি বছরের দীর্ঘজীবনের সবটাই ভাইমারে কেটেছে। তথাপি তাকে মাইন তীরবর্তী ফ্রাঙ্কফুর্টের ছাওয়াল বলা হয়।
প্রফেসর আবদুর রাজ্জাককে যদি একটা মাত্র পরিচয়ে শনাক্ত করতে হয়, আমার ধারণা ‘ঢাকার পোলা’ এর চাইতে অন্য কোনো বিশেষণ তার সম্পর্কে প্রযোজ্য হতে পারে না। তিনি ঢাকা জেলার কেরানীগঞ্জ থানায় জন্মগ্রহণ করেছেন। সেটাই তাকে ঢাকার পোলা বলার একমাত্র কারণ নয়। ঢাকার যা-কিছু উজ্জ্বল গৌরবের অনেক কিছুই প্রফেসর রাজ্জাকের মধ্যে খুঁজে পাওয়া যাবে। তিনি সবসময়ে ঢাকাইয়া ভাষায় কথা বলেন। ঢাকাইয়া বুলিতে যে একজন সুশিক্ষিত সুরুচিসম্পন্ন ভদ্রলোক মনের গহন ভাব অনুভাব বিভোব প্রকাশ করতে পারেন এবং সে প্রকাশ কতটা মৌলিক গুণসম্পন্ন হয়ে উঠতে পারে, রাজ্জাক সাহেবের মুখের কথা যিনি শোনেননি, কোনোদিন বুঝতে পারবেন না। ঢাকার পুরোনো দিনের খাবারদাবার রান্নাবান্না যেগুলো হারিয়ে গেছে অথবা হারিয়ে যাওয়ার পথে প্রফেসর রাজ্জাক তার অনেকগুলোই ধরে রেখেছেন। তার বাড়িতে এখনও প্রায় প্রতিদিনই কমপক্ষে একটা দুটো পদ ঢাকার খাবার রান্না করা হয়। খাওয়াদাওয়া, বান্নাবান্না, আচার-আচরণের ঢাকাইয়া বৈশিষ্ট্যগুলো প্রফেসর রাজ্জাক এবং তার পরিবার অতি সযত্নে রক্ষা করে আসছেন। নানা দেশের খাবার এবং রান্নাবান্নার প্রতি প্রফেসর রাজ্জাকের বিলক্ষণ অনুরাগ আছে। তার বাড়িতে বিদেশী খাবার রান্না হয় না এমন নয়। যখনই তিনি দেশের বাইরে গিয়েছেন, কমপক্ষে একপদ হলেও রান্না শিখে এসেছেন। ল্যাবরেটরিতে যেভাবে কেমিক্যাল কম্পাউন্ড পরীক্ষা করা হয়, সেরকম নিক্তি মাপা সতর্কতা সহকারে নতুন ভিনদেশী খাবার রান্না করা হয়। তাঁর পরিবারের মহিলারা বিদেশী খাবার পরীক্ষানিরীক্ষায় একরকম পারদর্শিতা অর্জনও করে ফেলেছেন। কিন্তু দেশীয় খাবার, বিশেষ করে পুরোনো দিনের খাবারের মর্যাদার জায়গাটি ভিনদেশী খাবার কখনো অধিকার করতে পারেনি। ঢাকার পুরোনো দিনের খাবারদাবারের প্রতি তার যে মমত্ববোধ, সেটা আমার কখনো অন্ধ ঐতিহ্যপ্রীতি মনে হয়নি। ঢাকার খাবারের কদর তিনি করেন, কারণ ওগুলো যথার্থই ভালো। উৎকর্ষের দিক দিয়ে পৃথিবীর অন্য যে-কোনো দেশের খাবারের সমকক্ষ।