তিনি ঘুম-জড়ানো স্বরেই জানতে চাইলেন, আইছেন ক্যান হেইডা কন।
আমাকে বলতেই হলো, বাংলা একাডেমী আমাকে পিএইচডি করার জন্য একটা বৃত্তি দিয়েছে। আমি তার কাছে এসেছি। একটা বিশেষ অনুরোধ নিয়ে, তিনি যেনো দয়া করে আমার গবেষণার পরামর্শক হতে সন্মত হন। আমার আর্জিটা যথাসম্ভব বিনয়নম জবানে প্রকাশ করলাম। কিন্তু প্রফেসর রাজ্জাকের মধ্যে তার সামান্যতম প্রতিক্রিয়াও লক্ষ করা গেলো না। তিনি পাশ ফিরে কথাটি নাকমুখ অবধি টেনে দিলেন। আমার এত বিনীত আবেদন এত নীরবে কোনো মানুষ প্রত্যাখ্যান করতে পারে, আমি চিন্তাও করতে পারিনি। তখন আমার দুটি কি তিনটি বই প্রকাশিত হয়েছে এবং মনেমনে অনেক সেয়ানা হয়ে উঠেছি। আমার আত্মাভিমানে একটু ঘা লাগলো। নিজেকেই জিগ্গেস করলাম, কেমন মানুষ এই প্রফেসর রাজ্জাক। আমি একটা অনুরোধ করলাম, আর শুনেই তিনি পাশ ফিরলেন। আমি তো অন্ততপক্ষে একজন লেখক। নিজের কাছে আমার দাম অল্প নয়। তিনি যেদিকে পাশ ফিরেছেন আমি ঘুরে চৌকির সেই পাশটিতে গিয়ে আবার বললাম, স্যার, আপনাকে আমার থিসিসের সুপারভাইজার হওয়ার জন্য অনুরোধ করতে এসেছি। আমার আর্জি দ্বিতীয়বার শুনে প্রফেসর রাজ্জাক আবার উত্তর দিকে পাশ ফিরলেন।
আমার ভীষণ রাগ ধরে গেলো। কেমনতরো মানুষ প্রফেসর রাজ্জাক! তার কাছে একটা আবেদন করলাম। তিনি ভালোমন্দ কোনো জবাব না দিয়ে নীরব প্রত্যাখ্যানের মাধ্যমে আমাকে বিদায় করতে চান। হতবাক হয়ে আমি কিছুক্ষণ দাড়িয়ে রইলাম। এইভাবে অপমানিত হয়ে যদি আমি চলে আসি আমার নিজের কাছে নিজে ছোট হয়ে যাই। কিছু একটা করা প্রয়োজন, কিন্তু কী করা যায়! প্রফেসরের বইয়ের গুদামে যদি আগুন লাগিয়ে দেয়া যেতো, মনের ঝাল কিছুটা মিটতো। কিন্তু সেটিতো আর সম্ভব নয়। আমি দু’হাত দিয়ে তার শরীর থেকে কাঁথাটি টেনে নিয়ে দলা পাকাতে পাকাতে বললাম, আমার মতো একজন আগ্রহী যুবককে আপনি একটি কথাও না বলে তাড়িয়ে দিতে পারেন, এত বিদ্যা নিয়ে কী করবেন? বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতো তিনি চৌকির ওপর উঠে বসলেন। পরনের সাদা আধময়লা লুঙ্গিটা টেনে গিঁট দিলেন। তারপর চশমাটা টেবিল থেকে তুলে নিয়ে কাচ মুছে নাকের আগায় চড়ালেন। খুব সম্ভব বাইফোকাল গ্লাস। আমি তাঁর দৃষ্টিশক্তির তীব্রতা অনুভব করলাম। কোনো মানুষের চোখের দৃষ্টি এত প্রখর হতে পারে আমার কোনো ধারণা ছিল না। তিনি আমার খদ্দরের পাজামা পাঞ্জাবি, পরনের স্পঞ্জ এবং ধুলোভর্তি মলিন চরণ সবকিছুর ওপর এক ঝলক দৃষ্টি বুলিয়ে নিলেন। তারপর আঙুল দিয়ে একটা আধাভাঙা কাঠের চেয়ার দেখিয়ে দিয়ে বললেন, ওইহানে বয়েন।
আমি যখন বসলাম, তিনি ভেতরে গেলেন। একটু পরে মুখে পানি দিয়ে ফিরে এলেন। তারপর খদ্দরের চাদরটা টেনে নিয়ে গায়ের ওপর মেলে দিলেন। আমার মনে হল তার পরনের গেঞ্জির বড় বড় ফুটো দুটো আমার দৃষ্টি থেকে আড়াল করার জন্যই চাদরটার সাহায্য নিলেন। যুত করে চেয়ারে বসার পর আমাকে বললেন, কী কাইবার চান, অখন কন।
আমি বললাম, আমি বাংলা একাডেমী থেকে পিএইচডি করার একটা ফেলোশিপ পেয়েছি, আমার খুব শখ আপনার অধীনে আমি গবেষণার কাজটা করি।
তিনি বললেন, গবেষণা করবেন। হেইডা ত ভালা কথা। কিন্তু আমি ত আপনের থিসিসের সুপারভাইজার থাকবার পারুম না।
প্রফেসর রাজ্জাকের কণ্ঠস্বর শুনে মনে হলো, তিনি আমার সঙ্গে কথাবার্তা বলবেন বলে একটা সিদ্ধান্ত এরই মধ্যে নিয়ে ফেলেছেন। আমি বললাম, কেনো স্যার?
অফিসিয়ালি থিসিস সুপারভাইজ করনের লাইগ্যা মিনিমাম রীডার অওন লাগে। আমি ত মোটে লেকচারার। সুতরাং আপনের শখ পূরণ অণ্ডনের কোনো সম্ভাবনা নাই।
তাঁর কথা শুনে আমি দমে গেলাম। তার পরেও বললাম, অন্য কারও অধীনে থিসিসটা রেজিষ্ট্রেশন নাহয় করলাম। তার পরামর্শ এবং নির্দেশনা নিয়েই আমি কাজটা করতে চাই। প্রফেসর রাজ্জাক বললেন, আপনের টপিক মানে বিষয়বস্তুটা কী?
আমি বললাম, দ্যা গ্রোথ অব মিডল ক্লাস ইন বেঙ্গল অ্যাজ ইট ইনফ্লয়েন্সড ইটস্ লিটারেচার, সোসাইটি অ্যান্ড ইকনমিকস ফ্রম এইটিনথ টু এইটিনথ ফিফটি এইট।
প্রফেসর রাজ্জাক বললেন, এক্কেরে ত সাগর সেঁচার কাম। কার বুদ্ধিতে এই গন্ধমাদন মাথায় লইছেন?
আমি বললাম, অন্য কারও পরামর্শে নয়, আমি নিজেই বিষয়টা বেছে নিয়েছি।
প্রফেসর রাজ্জাক কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। এরই মধ্যে কাজের ছেলেটা কল্কিতে তামাক দিয়ে গেলো। কয়েকটা টান দিয়ে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে বললেন, রেজিস্ট্রেশন ফর্ম রেডি করছেন?
আমাকে বলতে হল, আমাকে বৃত্তিটা দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। সেটা কার্যকর হবে এমএ-র রেজাল্টের পর। এখন পরীক্ষা চলছে।
তিনি বললেন, আগে পরীক্ষা দিয়া লন। যখন রেজাল্ট বাইর অইব তখন আয়েন।
আমি সালাম করে চলে আসছিলাম। তিনি বললেন, আরেকটু বইয়েন, এক পেয়ালা চা খাইয়া যান। তিনি দীপ্তি বলে কাউকে ডাকলেন। একটি গোলগাল ফর্সা কিশোরী বেরিয়ে এলে আমাকে জিগ্গেস করলেন, কী য্যান কইলেন আপনের নাম?
আমি বললাম, আহমদ ছফা।
তিনি বললেন, মৌলবি আহমদ ছফাকে এক পেয়ালা চা দে।
প্রফেসর রাজ্জাকের বাড়ি থেকে ফিরে আসার সময় তিনটে জিনিস আমার মনে দাগ কেটে বসে গিয়েছে। প্রথমত তার চোখের দৃষ্টি অসাধারণ রকম তীক্ষ্ণ। একেবারে মৰ্মে গিয়ে বেঁধে। দ্বিতীয়ত ঢাকাইয়া বুলি তিনি অবলীলায় ব্যবহার করেন, তার মুখে শুনলে এই ভাষাটি ভদ্রলোকের ভাষা মনে হয়। তৃতীয়ত আমাকে তিনি মৌলবি আহমদ ছফা বললেন কেনো? আদর করে বললেন, নাকি অবজ্ঞা করলেন? পরের বছরগুলোতে যতোবারই তাঁর কাছে গিয়েছি প্রতিবারই প্রথম সম্বোধনে জিগ্গেস করেছেন, মৌলবি আহমদ ছফা কী খবর?