ইন্টারভ্যুর প্রায় পনেরো দিন আগে মুনীর চৌধুরী সাহেবের সঙ্গে দেখা করে অনুরোধ করেছিলাম, তিনি যেনো সুপারিশ করেন, যাতে বাংলা একাডেমীর বৃত্তিটা পাই। চৌধুরী সাহেব আমাকে বলেছিলেন, যেহেতু তোমার এমএ-টা এখনও শেষ হয়নি, বাংলা একাডেমী তোমার আবেদন বিবেচনা নাও করতে পারে। তুমি যদি রাজি থাকো আমি তোমাকে অস্ট্রেলিয়া পাঠিয়ে দিতে পারি। ভাষাতত্ত্বের ওপর পিএইচডি করতে হলে শুধু গ্র্যাজুয়েশন থাকলে ওরা আপত্তি করবে না।
মুনীর চৌধুরী সাহেবের প্রস্তাব শুনে উল্লসিত হয়ে উঠেছিলাম। কিন্তু পরীক্ষণে নিজের ভেতর থেকে অনুভব করলাম, একটা সূক্ষ্ম আপত্তি জেগে উঠছে। আমি মাথা নিচু করে রইলাম এবং মেঝের দিকে তাকিয়ে বললাম, দুয়েক দিন ভেবে আপনাকে বলবো।
মুনির চৌধুরী সাহেবের প্রস্তাবটা গ্রহণ করবো কি না খুঁটিয়ে চিন্তা করতে গিয়ে আমার চোখে পানি এসে গেল। দেশের বাইরে যাওয়ার এরকম একটা স্কলারশিপ পেলে আমি বর্তে যাই। সুযোগটা আপনি এসে ধরা দিয়েছে। আমার নিজেকে ভাগ্যবান মনে করা উচিত। কিন্তু আমি সিদ্ধান্ত নিলাম অত্যন্ত সৌজন্য সহকারে প্রফেসর মুনীর চৌধুরীর প্রস্তাবটা প্রত্যাখ্যানই করবো। আর এই প্রত্যাখ্যান করতে হচ্ছে বলেই চোখে পানি এসে গিয়েছিল। সুযোগ তো জীবনে বারবার আসে না।
আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে ভরতি হয়েছিলাম এবং তিন বছর পড়াশোনা করেছি। খুব ভালো ছাত্র না হলেও আমার বুদ্ধি বিবেচনা নিতান্ত তুচ্ছ পর্যায়ের ছিল না। মাতৃস্তন্যে শিশুর যেরকম অধিকার, শিক্ষকদের স্নেহের ওপরও ছাত্রদের সেরকম অধিকার থাকা উচিত। সেই স্নেহ আমি শিক্ষকদের কাছ থেকে পাইনি। তার পরিণতি এই হল যে আমি বাংলা বিভাগ ছেড়ে দিলাম এবং প্রাইভেট প্রার্থী হিসেবে পরীক্ষা দিয়ে বিএ পাস কোর্সে পাশ করলাম। বিএ পাশ করার পর ঠিক করেছিলাম, অধিক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার আমার প্রয়োজন নেই। কিন্তু আমাকে আবার প্রাইভেটে পলিটিক্যাল সায়েন্সে এমএ পরীক্ষা দিতে হলো। সমস্ত বিষয়টা আমি এভাবে চিন্তা করলাম। শিক্ষকদের কাছ থেকে সামান্য উৎসাহ অনুপ্রেরণা যখন আমার ভীষণ প্রয়োজন ছিলো, সেই সময়ে কেউ আমার দিকে মুখ তুলে তাকাননি। যখন আমি নিজের চেষ্টায় উঠে আসতে শুরু করেছি, সকলে আমাকে অনুগ্রহ বিতরণ করে কৃতজ্ঞতাপাশে বাধতে চাইছেন। আমি মনে মনে স্থির করলাম, যে বস্তু প্রয়োজনের সময় হাজারবার কামনা করেও পাইনি, সেই বিশেষ সময়টি চলে যাওয়ার পর তার কিছু ক্ষতিপূরণ যদি আমার কাছে সোধে এসে ধরাও দেয়, আমি গ্রহণ করতে পারবো না। এই গ্রহণ করতে পারছি না বলেই চোখে পানি এসে গিয়েছিল। এরই মধ্যে একদিন তাঁর অফিসে গিয়ে বললাম, স্যার, ভাষাতত্ত্ব বিষয়টার প্রতিই আমি আকর্ষণ অনুভব করি না। সুতরাং উচিত হবে, স্কলারশিপটার জন্য অন্য কাউকে বেছে নেয়া। তিনি কিছুক্ষণ আমার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন।
মুনীর চৌধুরী সাহেব ছিলেন অত্যন্ত সংবেদনশীল মানুষ এবং তার বোধশক্তি ছিল অত্যন্ত তীক্ষ্ম। আমার ধারণা তিনি আমার অকথিত অভিযোগটি আঁচ করতে পেরেছিলেন। সে কারণেই আমার থিসিসটা বাংলা বিভাগের অধীনে রেজিষ্ট্রেশন করার জন্য চাপাচাপি করছিলেন। আমাদের ফাইনাল পরীক্ষা শেষ হতে হতে উনিশশো একাত্তর সালের মার্চ মাস এসে গেলো। মার্চ মাসের একুশ তারিখে আমাদের ভাইভা-ভোসি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হল। পঁচিশে মার্চ তারিখের মধ্যরাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী তো ঘুমন্ত ঢাকা নগরীর ওপর আক্রমণ করেই বসলো। আমাদের মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলো। নয় মাস পর যখন ভারত থেকে দেশে এলাম, তখন প্রফেসর মুনীর চৌধুরী বেঁচে নেই। পাকিস্তানপন্থী রাজাকার-বাহিনী তাকে অন্যান্য বুদ্ধিজীবীর সঙ্গে রায়ের বাজারের বধ্যভূমিতে নিয়ে গুলি করে হত্যা করে। তার জন্য শোকার্ত সকল মানুষের সঙ্গে কণ্ঠ মেলাতে গিয়েও আমার একান্ত ব্যক্তিগত বেদনাটুকু বড় বেশি করে অনুভব করছিলাম। আমি এমন একজন মানুষকে হারালাম যিনি অভিমানের ভাষা বুঝতে পারতেন।
আমার একটা অপরাধবোধ রয়েছে। প্রচলিত নিয়ম ভেঙে সুযোগ দেয়ার পরও আমার পক্ষে পিএইচডি করা সম্ভব হয়নি। একা একা যখন চিন্তা করি আমার মনে একটা অপরাধবোধ ঘনিয়ে আসে। হয়তো আমি নিজের উগ্র অহংটাকে বড় বেশি প্রাধান্য দিয়ে প্রফেসর মুনীর চৌধুরীর উদারতার প্রতি অবিচার করেছিলাম। আজকাল সেরকম একটা অনুভূতি আমার মধ্যে জাগ্রত হয়। বোধহয় সেজন্য আমার পক্ষে পিএইচডি করা সম্ভব হয়নি। এটা হচ্ছে আমার অনুভব। পিএইচডি শেষ করতে না পারার অন্য যে বাস্তব কারণ তার জন্য প্রফেসর আবদূর রাজ্জাককে আমি দায়ী মনে করি।
০২. প্রফেসর আবদুর রাজ্জাক
প্রফেসর আবদুর রাজ্জাকের সঙ্গে পরিচিত হওয়া আমার জীবনের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাসমূহের একটি। দৃষ্টিভঙ্গির স্বচ্ছতা নির্মাণে, নিষ্কাম জ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রে, প্রচলিত জনমত উপেক্ষা করে নিজের বিশ্বাসের প্রতি স্থিত থাকার ব্যাপারে প্রফেসর আবদুর রাজ্জাকের মতো আমাকে অন্য কোনো জীবিত বা মৃত মানুষ অতোটা প্রভাবিত করতে পারেনি। প্রফেসর রাজ্জাকের সান্নিধ্যে আসতে পারার কারণে আমার ভাবনার পরিমণ্ডল বিস্তৃততর হয়েছে, মানসজীবন ঋদ্ধ এবং সমৃদ্ধতিরো হয়েছে। আমি যদি বসওয়েলের মতো পরিপাটি স্বভাবের মানুষ হতাম, কিংবা একারমানের মতো শৃঙ্খলা নিষ্ঠ আনুগত্য আমার থাকত, বসওয়েল যেভাবে জনসনের একটি বিশ্বাসযোগ্য চরিত্র সকলের সামনে তুলে ধরতে পেরেছেন, অথবা একারমান যেরকম অখণ্ড বিশ্বস্ততা সহকারে দিন তারিখ প্রহর উল্লেখ করে মহাকবি গ্যোতের কথোপকথন লিপিবদ্ধ করে রেখে গেছেন, সে ধরনের একটা গ্রন্থ প্রফেসর রাজাকের ওপর রচনা করা হয়তো আমার পক্ষে অসম্ভব হত না। আমি গল্প কবিতা উপন্যাস এসকল জিনিস লিখে থাকি এবং লিখে আনন্দ পেয়ে থাকি। সৃষ্টিশীল মানুষেরা সাধারণত বিপজ্জনক ধরনের হয়ে থাকেন। বাইরে তারা যতোই নিরীহ এবং অপরের প্রতি মনোযোগী হয়ে থাকুন না কেনো ভেতরে তাদের স্বেচ্ছাচারী হওয়া ছাড়া উপায় থাকে না। যেখানে আত্মপ্রকাশের বিষয়টি অপর সকল কিছুকে ছাপিয়ে ওঠে, সেখানে ব্যক্তিকে অনিবাৰ্যভাবে স্বেচ্ছাচারী হয়ে উঠতে হয়। সৃষ্টিধর্মের নিয়ম ছাড়া বাইরের কোনো নিয়ম সেখানে ক্রিয়াশীল হয়ে উঠতে পারে না।