তারপর একটা বিস্কুটের এককোণা দাঁতে কেটে নিয়ে চায়ে মুখ দিলেন। চা শেষ করে সুইডেনের জাতীয় পতাকা উড়িয়ে ক্যাডিলাকে করে চলে গেলেন।
সুইডিশ রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাতের পর আজকের দিনের দ্বিতীয় কর্মসূচি বোটানি ডিপার্টমেন্টের প্রফেসর নিয়োগের ইন্টারভু। প্রফেসর নিয়োগের বেলায় উপাচার্যকে প্রিসাইড করতে হয়, এটাই নিয়ম। সায়েন্স ফ্যাকাল্টির ডীন বোটানি ডিপার্টমেন্টের চেয়ারম্যান এবং এক্সটার্নেল হিসেবে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বোটানির চেয়ারম্যান তিনজনই উপস্থিত আছেন। তিনজন মাত্র প্রার্থী। প্রতিটি প্রার্থীর ফাইল এবং আবেদনপত্র হাজির করা হয়েছে। আবু জুনায়েদের মুখে একটা থমথমে গাম্ভীর্য, তিনি বেল বাজিয়ে বেয়ারাকে বললেন প্রথম ক্যান্ডিডেট ড. আদনানকে আসতে বলো।
তিনি চেম্বারে প্রবেশ করলে আবু জুনায়েদ চেয়ার দেখিয়ে বললেন, প্লিজ টেক ইওর সিট।
ড. আদনান বসলে কাগজপত্র দেখার পর জিজ্ঞেস করলেন আপনি ইউ. এস. এ. থেকে ডক্টরেট করেছেন?
ড. আদনান জবাব দিলেন,
-আমি ইউ. এস. এ’র মিশিগান য়ুনিভার্সিটি থেকে ডক্টরেট এবং পোস্ট ডক্টরেট করেছি। মিয়া মুহম্মদ আবু জুনায়েদ একটা অদ্ভুত প্রশ্ন করলেন,
-আচ্ছা ড. আদনান, আপনি আমাকে বলুন তো, গাভীন গরু পাতলা পায়খানা করলে কী করতে হয়?
উপাচার্য সাহেবের প্রশ্ন শুনে আদনানের হেসে উঠতে ইচ্ছে হলো। কিন্তু সংযম রক্ষা করলেন এবং বললেন,
-স্যার কী করতে হবে আমার জানা নেই। আমার বিষয় অ্যানিমাল হাজব্যান্ডি নয়, বোটানি।
আবু জুনায়েদ হঠাৎ করে উঠে দাঁড়িয়ে বোর্ডের অন্যান্য সদস্যদের বললেন,
-আপনারা ইন্টারভিউটা চালিয়ে নিন। আমি থাকতে পারছিনে। আমার গরুটার অসুখ। তারপর তিনি অফিস রুমের বাইরে চলে এলেন।
আবু জুনায়েদের গাড়ি অফিস থেকে যখন উপাচার্য ভবনের কম্পাউন্ডে ঢুকল, জুনায়েদ দেখেন অনেক মানুষের ভিড়। ছাত্রছাত্রী, পাড়ার মহিলা, তরুণ শিক্ষকদেরও অনেককে দেখতে পেলেন। আবু জুনায়েদ চিন্তা করলেন, এই অল্প সময়ের মধ্যে গোটা বিশ্ববিদ্যালয়ে তার গরুটি সকলের ভালবাসার পাত্র হয়ে উঠেছিল। কী আবেগ নিয়েই না সকলে অসহায় পশুটিকে দেখতে আসছে। দলে দলে মানুষ গোয়ালঘরের দিকে যাচ্ছে এবং গোয়ালঘর থেকে আসছে। গরুটি বিশ্ববিদ্যালয়ের জীবন্ত সত্তার অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছিল, সে কথা আবু জুনায়েদ জানতেন না। তার চোখ ফেটে পানি বেরিয়ে আসছিল। তিনি গাড়ি থেকে নেমে ধীর মন্থর গতিতে গোয়ালঘরের দিকে গেলেন। সকলে তাকে পথ ছেড়ে দিল। তিনি নীরবে গোয়ালঘরের সামনে এসে দাঁড়ালেন। গরুটি কাত হয়ে শুয়ে পড়েছে। তার মুখটা মাটিতে ঠেকিয়ে রেখেছে। ফেনায় গোয়ালের সবটা মেঝে ভেসে যাচ্ছে। সুন্দর চোখ দুটো বোজা। মলদ্বারের পাশে বিন্দু বিন্দু রক্ত লেগে রয়েছে। কাঞ্চন ছেলেটা গরুর গায়ে হাত দিয়ে বসে আছে। চুপচাপ। তার চোখ পানিতে ভেসে যাচ্ছে। আবু জুনায়েদ কাউকে কিছু না বলে উপরে গিয়ে গায়ের কাপড়চোপড়, পায়ের জুতো কিছুই না খুলে বিছানায় নিজেকে ঢেলে দিলেন।
আবু জুনায়েদ ঘুমিয়ে পরেছিলেন। ঘুমের মধ্যে তিনি একটা স্বপ্ন দেখলেন। শেখ তবারক আলী তাকে হাত ধরে গরুর মৃতদেহটার কাছে নিয়ে গেলেন। গরুটার দিকে আঙুল দেখিয়ে বলছেন, কী জামাই মিয়া আপনাকে কি আমি সঠিক পথ দেখাইনি। স্বপ্নটা দেখেই তিনি জেগে গিয়েছিলেন। এই রকম স্বপ্ন কেন দেখলেন, তার অর্থ কী হতে পারে! আরো কত বিপদ তার জন্য অপেক্ষা করে আছে কে জানে?
এই সময়ে তার ব্যক্তিগত সহকারী হন্তদন্ত হয়ে ঘরে ঢুকে চাপাস্বরে বললেন, স্যার স্যার এডুকেশন মিনিস্টার অনেকক্ষণ পর্যন্ত লাইনে আপনার জন্য অপেক্ষা করছেন। আবু জুনায়েদকে তড়িতাহতের মতো উঠে টেলিফোনের কাছে যেতে হলো। রিসিভার কানে লাগিয়ে সালাম দিতে হলো। যত বিপদই থাকুক উপর থেকে টেলিফোন এলে কণ্ঠস্বরে বিনীত ভাব ফুটিয়ে তুলে কীভাবে জবাব দিতে হয় সেটা আবু জুনায়েদের ধাতস্ত হয়ে গেছে। রিসিভার উঠিয়ে বিনীত কণ্ঠে বললেন,
-স্যার, আসোলামু আলাইকুম, আবু জুনায়েদ।
শিক্ষামন্ত্রী ওপ্রান্ত থেকে উৎসাহব্যঞ্জক কণ্ঠস্বরে ইংরেজিতে এবং তারপরে বাংলায় বললেন,
-মি: জুনায়েদ আই কগ্রাচুলেট ইউ অব বিহাফ অব অনারেবল প্রাইম মিনিস্টার এন্ড মাই ওন বিহাফ। প্রাইম মিনিস্টার হ্যাজ আসড মি ইনফর্ম ইউ, ইউ আর দ্য মোস্ট ফেবার্ড এবং লাকি পারসন টু রিপ্রেসেন্ট বাংলাদেশ ইন ফিফটি ওয়ান আমেরিকান য়ুনিভার্সিটিস। উত্তর থেকে দক্ষিণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মোট একান্নটা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাদের শিক্ষা-সংস্কৃতির উপর পরিচয়মূলক বক্তৃতা দিতে হবে । প্রতি বক্তৃতার সময় প্রশ্নোত্তরসহ আড়াই ঘণ্টা। প্রতিটি বক্তৃতার জন্য আপনাকে চার হাজার ডলার করে সম্মানী দেবে। এটা গুরুদায়িত্ব এবং সম্মানজনক দায়িত্ব। আপনার হাতে পঁচিশ দিন মাত্র সময় আছে। এরই মধ্যে যাবতীয় ফর্মালিটিজ সারতে হবে । বক্তৃতাগুলোর বিষয়বস্তু ছকিয়ে নিতে হবে এবং ফ্যাক্টস এন্ড ফিগার যোগার করতে হবে। সুতরাং বিশেষ সময় নেই। এই মুহূর্ত থেকে কাজে লেগে যান। প্রধানমন্ত্রী যাওয়ার আগের দিন আপনার অনারে একটা ডিনার দেবেন। সময়টা আমিই পরে জানাব।