দারোয়ান করজোড়ে আবার নুরুন্নাহার বানুকে সালাম করল।
নুরুন্নাহার বানু ঘুরতে ঘুরতে গোয়ালঘরে এলেন। গরুটা দাঁড়িয়ে আছে, সুন্দর লেজটা দিয়ে মাছি তাড়াচ্ছে। তার ছলছল চোখ দুটোয় নুরুন্নাহার বানুর চোখ গেল । তিনি পেটে হাত রাখলেন, ভেতরে বাচ্চাটি নড়াচড়া করছে টের পেলেন। এমন গাভীন একটি গরুকে তিনি বিষ দিয়ে হত্যা করবেন! মনে একটা মমতা জন্মাল। গরুটা সত্যিই সুন্দর। কিন্তু তার মনের ভেতর দীর্ঘদিনের কুণ্ডুলি পাকানো সংকল্পটা জীবন পেতে শুরু করছিল। তিনি কাজটা করবেন কি না ঠিক করতে পারছেন না। গোটা কম্পাউন্ডটা আগাগোড়া দুচার চক্কর দিলেন। তার একে একে মনে পড়তে লাগল, গরুটা আসার পর থেকে কীভাবে তার উপর দুর্যোগ নেমে এসেছে। স্বামী পর হয়ে গেছে, মেয়ে খানকি হওয়ার উপক্রম, তার নিজের জীবন থেকে শান্তি সুখ কীভাবে বিদায় নিয়েছে। গরুটা যদি বেঁচে থাকে নুরুন্নাহার বানুর আর কোনোই আশা নেই। নুরুন্নাহার কি স্বামী সংসার নিয়ে বেঁচে থাকতে চান, তাহলে গরুটি কোনোমতেই বেঁচে থাকতে পারে না। তার মন কঠিন হয়ে উঠল, যা করবার তাকে তাড়াতাড়ি করে ফেলতে হবে। মনের এই দৃঢ়তা কতক্ষণ রাখতে পারবেন তিনি জানেন না। নুরুন্নাহার বানু নিজের কাছে নিজে পরাজিত হতে চান না। তার চলার বেগ অত্যন্ত দ্রুত হয়ে গেল। হৃৎপিণ্ডের ধুক ধুক শব্দ তিনি শুনতে পাচ্ছিলেন। তাড়াতাড়ি দোতালায় উঠে প্লাস্টিকের কৌটার ভেতর থেকে পলিথিনে ঢাকা পুরিয়াটা নিয়ে নেমে এলেন এবং গুঁড়োগুলো জাউয়ের গামলার মধ্যে স্পর্শ বাঁচিয়ে ছড়িয়ে দিলেন। আপন হাতে একটি গাছের ডাল ভেঙে গুলতে লাগলেন। তারপর উপরে উঠে পরনের শাড়িটা বদলে ড্রাইভার ডেকে গাড়িতে চড়ে মীর হাজিরবাগে বোনের বাড়িতে চলে গেলেন।
.
১৫.
নরসিংদি থেকে মিয়া মুহম্মদ আবু জুনায়েদের ফেরার কথা ছিল বিকেলের দিকে। কিন্তু তার ফিরতে ফিরতে রাত এগারটা হয়ে গেল। পথে এক জায়গায় একটা প্রাইভেট কার একজন কলেজ ছাত্রকে চাপা দিয়ে চলে গেছে এবং ছেলেটি সঙ্গে সঙ্গে মারা গেছে। ক্ষিপ্ত ছাত্ররা ছাত্র হত্যার প্রতিশোধস্বরূপ যত প্রাইভেট কারের দেখা পেয়েছে, ইচ্ছেমতো ভাঙচুর করেছে, কোনো কোনো আরোহীকে জোর করে নামিয়ে পিটিয়েছেও। ভয়ে ওই রাস্তা দিয়ে কোনো গাড়ি আসতে সাহস পাচ্ছিল না। আবু জুনায়েদকেও অনেক ঘুরপথ দিয়ে গাড়ি চালিয়ে আসতে হয়েছে। বিপদের উপর বিপদ। বড় রাস্তায় যেই উঠেছে পেছনের চাকাটা পাংচার হয়ে গেল। অতিরিক্ত কোনো চাকা সঙ্গে ছিল না। তাই দুমাইল ঠেলে গাড়িকে নিকটবর্তী গ্যারেজে আনতে হয়েছে। আবু জুনায়েদকে নিজেকেও এই ঠেলাঠেলির কাজে হাত রাখতে হয়েছে। গ্যারেজে নতুন চাকা লাগিয়ে আবার চলা শুরু করতে ঘণ্টাখানেক সময় চলে গেল। তার খেয়ে ঘণ্টাখানেক আরাম করার অভ্যেস। আজকে সেটি হয়নি। তাছাড়া আরো নানারকম ধকল গেছে। শিক্ষা সপ্তাহের শুরুর দিন নরসিংদিতে দুদল ছাত্রের মধ্য মারামারি হয়েছে। ক্ষুধা তৃষ্ণা শ্রান্তিতে তার চোখ বুজে আসছিল।
তিনি যখন উপাচার্য ভবনের কম্পাউন্ডে এলেন দেখেন গেট খোলা। ভেতরে মানুষজনের আনাগোনা। গোয়ালঘরে অনেক মানুষের কণ্ঠস্বর শোনা যাচ্ছে। তিনি কোনোরকমে গাড়ি থেকে নেমে দারোয়ানকে কাছে পেয়ে জিজ্ঞেস করলেন কী হয়েছে?
দারোয়ান বলল,
-দুপুরবেলা থেকে গরুটা হড় হড় করে পাতলা পায়খানা করছে, কিছুতেই বন্ধ হচ্ছে না, আর মুখ দিয়ে ফেনা আসছে।
আবু জুনায়েদ জিজ্ঞেস করলেন,
-বেগম সাহেবা কোথায়?
দারোয়ান জবাব দিল,
-বেগম সাহেবেরও শরীর ভীষণ খারাপ। বড় আপার বাসায় গিয়ে বেহুঁশ হয়ে পড়েছিলেন। উপরে তিনি আছেন। এখন অল্প অল্প জ্ঞান ফিরেছে। ডাক্তার দেখছেন।
আবু জুনায়েদ বেগমকে দেখতে উপরে না গিয়ে গরু দেখতে গোয়ালঘরে চলে গেলেন। গোয়ালঘরে এই এত রাতেও অনেক মানুষ। মাওলানা তাহের, জনার্দন চক্রবর্তী, ড. আনোয়ারুল আজিমসহ সান্ধ্য আসরের প্রায় সমস্ত সদস্য উপস্থিত আছেন। একপাশে শেখ তবারক আলী। তার পাশে এক ভদ্রলোক ব্যাগ হাতে দাঁড়িয়ে আছেন। আবু জুনায়েদ ধরে নিলেন তিনি ডাক্তার হবেন।
গরুটার অবস্থা দেখে আবু জুনায়েদের ডুকরে কেঁদে উঠতে ইচ্ছে হলো। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে থর থর করে কাঁপছে। দুটো অসহায় স্বচ্ছ টলোটলে চোখ থেকে পানির দুটো ধারা গড়িয়ে নিচের দিকে নেমে আসছে। মলদ্বার দিয়ে পিচকারির মতো বেগে পাতলা পায়খানা ছুটছে। আবু জুনায়েদ ভালো করে দেখার জন্য যেই পেছনের দিকে গিয়েছেন ছড় ছড় করে পায়খানা ছুটে এসে তার কোট প্যান্ট সব ভরিয়ে দিল। সে সবের পরোয়া না করে আবু জুনায়েদ মলদ্বারের গোড়া পরীক্ষা করে দেখেন, মলদ্বারের গোড়ায় ফোঁটা ফোঁটা রক্তের দাগ। গরুটির মুখে ফেনা ভাঙছে তো ভাঙছেই। সমুদ্রের জোয়ার নেমে যাওয়ার পর বেলাভূমিতে যে রকম ফেনা পড়ে থাকে গোয়ালঘর জুড়ে সর্বত্র ফেনার দাগ দেখতে পেলেন। আবু জুনায়েদ কী করবেন বুঝতে পারলেন না। তিনি কোটপ্যান্টসুদ্ধ হাঁটু মুড়ে গরুর পাশেই বসে পড়লেন। তারপর শিশুর মতো, বৃদ্ধের মতো, পুত্রহারা মেয়ে মানুষের মতো বুক চাপড়ে হু-হুঁ করে কেঁদে উঠলেন। উপস্থিত মানুষরা তাকে কেউ কিছু বলতে পারলেন না। এক সময় কান্নার বেগও শান্ত হয়ে এল। কিন্তু গরুটি পাতলা পায়খানা করেই যাচ্ছে।