যে মেয়েকে পেটে ধরেছেন, এতদিন মানুষ করেছেন, সে চোখে চোখ রেখে নুরুন্নাহার বানুকে এই সকল কথা বলতে পারে, তারপরেও নুরুন্নাহার বানু কোন মুখে আনে?
বটবৃক্ষের তলে গেলাম ছায়া পাইবার আশে
পত্র ছেদি রৌদ্র পড়ে আমার আপন কর্মদোষে
নদীর ধারে বইস্যা রইলাম নৌকা পাইবার আশে
আমারে দেখিয়া নৌকা দূরে দূরে ভাসে।
তারপরে তবারক হারামজাদা জুটিয়ে দিয়েছে এক মায়াবিনী গরু। আবু জুনায়েদের কাছে তার গরুটাই সবকিছু। গরুর সঙ্গে তার সংসার। গরু ঘরে তার অফিস কাজকর্ম সমাজ নামাজ সব। নুরুন্নাহার বানু কিছু নন। গরুটিকে সতীন মনে করবেন তেমন উপায়ও নেই। যদি তিনি সতীনের মর্যাদা পেতেন, স্বামীর অন্তত একটা অংশের উপর তার অধিকারবোধ বজায় থাকত। এই বিশ্ববিদ্যালয় পাড়ার বুড়ো আধবুড়ো সব বেটাছেলেরা আবু জুনায়েদের গরুকে নিয়ে এখন রঙ্গরসে মত্ত রয়েছে। এই এলাকার সমস্ত পুরুষ মানুষদের সম্পর্কে নুরুন্নাহার বানুর অত্যন্ত খারাপ একটা কথা বলতে ইচ্ছে করে। একটা গরুর পেছনে যে সকল পুরুষ মানুষ এমন ধুন্ধুমার কাণ্ড করে বেড়ায় কোন্ যুক্তিতে নুরুন্নাহার বানু তাদের সুস্থ মানুষ মনে করবে?
এতদিন অন্তু ছিল, রেবা ছিল, তার বর ছিল। নুরুন্নাহার বানুর সবটুকু শূন্যতাবোধ, সবটুকু রিক্ততা মেয়ে জামাই নাতি মিলে ভরিয়ে রেখেছিল। ওরা সব গত কাল চলে গেছে। রেবার বরের বদলির চাকরি। এই সপ্তাহের মধ্যে তাকে চট্টগ্রামে গিয়ে জয়েন করতে হবে। নুরুন্নাহার বানুর কোনো ছেলে নেই। তার খুব ইচ্ছে ছিল রেবার বরটিকে একটা চাকরি দিয়ে রেবা এবং অন্তুকে এখানে রেখে দেবেন। অদ্ভুটা থাকলেই নুরুন্নাহার বানুর চলে যেত। আবু জুনায়েদ তার পেয়ারের গাভীটি নিয়ে যা ইচ্ছে করুন, নুরুন্নাহার বানু মুখটিও খুলতেন না। তিনি কি তেমন বাপের মেয়ে যে, ছোটলোকের বাচ্চাদের এসকল জঘন্য কাণ্ড নিয়ে ঘাটাঘাটি করবেন? আবু জুনায়েদ কি তার অন্তরের করুণ হাহাকারটির কথা একবারও ভাবতে চেষ্টা করেছেন? ভাববেন কেন, তিনি কি আর মানুষের পর্যায়ে আছেন। এই পাড়ার সমস্ত নষ্ট মানুষদের নিয়ে গোয়ালঘরে সকাল-সন্ধ্যা কাটাচ্ছেন। আবু জুনায়েদ কি ইচ্ছে করলে রেবার বরকে এখানে একটা চাকরি দিয়ে রেবা এবং অন্তুকে ঢাকা শহরে রাখার ব্যবস্থা করতে পারতেন না? প্রতিদিন তার হাত দিয়েই তো কত মানুষের চাকরি হচ্ছে। আপন পেটের মেয়ের জামাই, তাকে একটি চাকরি দিলে কি আবু জুনায়েদের আদরের গাই গরুর সোনার অঙ্গ খসে যেত? আবু জুনায়েদ নুরুন্নাহার বানুকে আর কত উলঙ্গ করতে পারেন? আর কত নিচে নামাতে পারেন?
নুরুন্নাহার বানু কি বিনা প্রতিবাদে আবু জুনায়েদের এই জঘন্য অন্যায় মেনে নিতে পারেন। আজকে যদি তার আব্বা বেঁচে থাকতেন, একটা গাই গরুর কাছে তার মেয়েকে এমন ছোট করা কি সহ্য করতে পারতেন? তিনি আপন হাতে রামদায়ের একটা মাত্র কোপ দিয়ে ছোটলোকের বাচ্চার মাথা ফাঁক করে ফেলতেন এবং গাই গরুটি জবাই করে জেয়াফত খাওয়াতেন, নুরুন্নাহর বানু তেমন ঝালঅলা বাপের বেটি । আবু জুনায়েদের গরু পীরিতের শেষ দেখে তিনি ছাড়বেন। গরুটিকে তিনি আপন হাতে বিষ দিয়ে হত্যা করবেন। তাহলেই তার শরীরের ঝাল মেটে। ইতোমধ্যে তিনি বিষ সংগ্রহ করে ফেলেছেন। সেজন্য তাকে একটু কষ্ট করতে হয়েছে বৈকি। তার পুরনো কাজের বুয়া ছমিরনের মাকে নগদ একটি হাজার টাকা দিতে হয়েছে। পুরনো একটি শাড়িও বুড়ি মাগিটি তার কাছ থেকে আদায় করে নিয়েছে, গরুটি ভালোভাবে মারা যাবে, সেই মারা যাওয়ার কাজটি নিরাপদে হয়ে গেলে, নুরুন্নাহার বানুকে তার সাহেবকে মানে আবু জুনায়েদকে বলে ছমিরনের স্বামীর একটি চাকরি ঠিক করে দিতে হবে। এতকিছু করার পরেই মাগি গ্রামে গিয়ে চামারের কাছ থেকে গরুর বিষ এনে দিয়েছে।
শুক্রবার দিন মিয়া মুহম্মদ আবু জুনায়েদকে নরসিংদি যেতে হলো। আবু জুনায়েদের ইচ্ছে ছিল না। আজ পশু হাসপাতাল থেকে গরুটাকে দেখার জন্য ডাক্তার আসার কথা ছিল। গর্ভাবস্থার এখন ছমাস চলছে। শরীর ভারী হয়ে উঠছে। তরণীর চঞ্চলতা অনেকখানি থিতিয়ে এসেছে। ডাক্তার কী বলেন, আবু জুনায়েদের শোনার ইচ্ছে ছিল। শিক্ষা সচিব যাচ্ছেন, শিক্ষামন্ত্রী যাচ্ছেন, আবু জুনায়েদ না বলবেন কেমন করে। সরকারের অধীনে চাকরি আবু জুনায়েদের। আজ সপ্তাহব্যাপী উৎসবের সূচনা। একেবারে শেষ দিন প্রধানমন্ত্রী যাবেন। ঘর থেকে বেরোবার আগে আবু জুনায়েদ গোয়াল ঘরে গেলেন। গত দিন দেখাশোনার লোকটা চলে গেছে তার আসতে একটু বেলা হবে। কারণ তাকে বউকে নিয়ে হাসপাতালে যেতে হবে। সকালে যাতে ‘তরণী’ ব্রেকফাস্ট করতে পারে সেজন্য রাতেই তার জন্য গামলাতে আতপ চালের জাউ তৈরি করে রেখে যাচ্ছে। কেউ জাউটা তরণীর সামনে ঠেলে দিলেই চলবে। তরণী জাউ শেষ করার আগেই সে বউকে বাসায় রেখেই চলে আসবে।
আবু জুনায়েদ বাড়ি থেকে বের হওয়ার পর নুরুন্নাহার বানুর হঠাৎ কেমন জানি ইচ্ছে হলো তিনি নিচে গিয়ে একটু হেঁটে আসবেন। আবু জুনায়েদ বাইরে টাইরে কোথাও গেলে তিনি কম্পাউন্ড পরিক্রমার কাজটা বেশ ভালোভাবেই করেন। দারোয়ান মালি ঝাড়দার এ সকল তৃতীয় চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীরা তাকে দেখে তটস্থ হয়ে ওঠে, হুকুম তামিল করার জন্য তৎপর হয়ে ওঠে, মনে যত কষ্টই থাকুক এটা তিনি মহা আনন্দে উপভোগ করে থাকেন। আজকে তিনি নিচে নেমে দেখেন সবটা ফাঁকা। ঝাড় দেয়া শেষে ঝাড়ুদারেরা চলে গেছে। মালিরাও অনুপস্থিত। কেবল এক দারোয়ান গেটে দাঁড়িয়ে সিগারেট ফুঁকছে। নুরুন্নাহার বানুকে দেখতে পেয়ে মুখের সিগারেট ছুঁড়ে দিয়ে সালাম দিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ালো। নুরুন্নাহার বানু দারোয়ানের কাছে তার অসুস্থ মেয়েটির সংবাদ জিজ্ঞেস করলেন। দারোয়ান জানালো, বেগম সাহেবের অশেষ মেহেরবাণী। আল্লাহর রহমতে তার মেয়ে সুস্থ। দুঃসময়ে বেগম টাকাটা ধার না দিলে মেয়ের চিকিৎসা করানো তার পক্ষে সম্ভব হতো না। এক তারিখ মাইনে পেলে সে ঠিক বেগম সাহেবার টাকাটা শোধ করে দেবে। বেগম সাহেব তার বড় উপকার করেছেন, সে কথা সারা জীবন মনে থাকবে। নুরুন্নাহার বানু বললেন, ঠিক আছে হাশমত ঐ টাকা কটা তোমাকে একেবারেই দিয়ে দিলাম। শোধ দিতে হবে না।