জুয়েল ঝুঁকে পড়ে আবু জুনায়েদের পদধূলি নিয়ে মুখে এবং কপালে মাখল।
মাজহারুল করিম জুয়েল চলে যাওয়ার পর আবু জুনায়েদের ধারণা হতে থাকল তিনি বিশেষ ধরনের কামালিয়াত হাসিল করে ফেলেছেন। যা ভাবেন তাই ঘটে যাবে। তার অগ্রযাত্রা ঠেকায় সাধ্য কার?
.
১৪.
নুরুন্নাহার বানু ভীষণ একটা অবস্থার মধ্যে পড়ে গেছেন। বিয়ে হওয়ার পর থেকেই তার মনে এমন একটা আত্মবিশ্বাস জন্ম নিয়েছিল যে আবু জুনায়েদকে ডাইনে বললে ডাইনে, বামে বললে বামে, সামনে পেছনে যেদিকে ইচ্ছে চালিয়ে নেয়ার ক্ষমতা তিনি রাখেন। তিনি মনে করতেন আবু জুনায়েদ হলেন একটা লক্কর-ঝক্কর গাড়ি, আর এমন গাড়ি যে পথে চলতে গেলে মাঝে-মাঝে থমকে দাঁড়ায়। দুর্ঘটনার ভয়ে মেইন রাস্তা ছেড়ে অলিগলিতে ঘোরাঘুরি করতে পছন্দ করে। আবু জুনায়েদকে ভাঙাচোড়া গাড়ির সঙ্গে তুলনা করতেন আর নিজেকে মনে করতেন রদ্দি জগদ্দলের প্লাটিনামে মোড়া চকচকে স্টিয়ারিং হুইল। নুরুন্নাহার বানুর আব্বা টাকাপয়সা দিয়েছিলেন বলেই আবু জুনায়েদ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করতে পেরেছেন। পেছনে তার বাবা না থাকলে আবু জুনায়েদের বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হওয়া দূরে থাকুক ছাত্র হওয়ার সুযোগ পর্যন্ত জুটত না। নুরুন্নাহার বানুর মতো ভাগ্যবতী মহিলাকে বিয়ে করেছিলেন বলেই আবু জুনায়েদ অত সহজে বাঘা বাঘা মানুষদের পাশ কাটিয়ে উপাচার্যের চাকরিটা পেয়ে গেছেন। আবু জুনায়েদ আজকে যা হয়েছেন তার সামান্য অংশ নুরুন্নাহার বানুর বাবার তৈরি, আর বাদবাকি সবটা নিজের হাতে তিনি ঢালাই করেছেন। আবু জুনায়েদের কোনো ভূমিকা, কোনো কৃতিত্ব নেই। নুরুন্নাহার বানু অনুগ্রহ করে পেটে ধারণ করতে রাজি হয়েছিলেন বলেই আবু জুনায়েদ সন্তানের বাবা হতে পেরেছেন। নুরুন্নাহার বানু মনে করেন, পেছনে তিনি থাকলে আবু জুনায়েদকে লাফাঙ্গারের মতো ঘুরে বেড়াতে হতো। বিয়ে হওয়ার ছাব্বিশ বছর পর্যন্ত নুরুন্নাহার বানুর বেঁধে দেয়া ছকের মধ্য দিয়ে আবু জুনায়েদের সংসারের যাত্রা চলছিল। সবকিছু বাঁধাধরা, কোনো অনিয়ম দুর্ঘটনার বালাই নেই। মাঝে-মাঝে ঝগড়াঝাটি, অল্পস্বল্প যে মনোমালিন্য হতো না তা নয়। কিন্তু সেগুলো নুরুন্নাহার বানুর পরিকল্পনার ভেতরের জিনিস। মেয়ে মানুষ এবং পুরুষ মানুষের একসঙ্গে দীর্ঘকাল বাস করতে হলে অল্পবিস্তর ঝগড়াঝাটি মান-অভিমান থাকা খুবই প্রয়োজন। নইলে জীবন আলুনি এবং বিস্বাদ হয়ে যায়। ঝগড়াঝাটি সময় বিশেষে সংসার রথের চাকায় ওয়েল্ডিং-এর কাজ করে। সুতরাং নুরুন্নাহার বানু যখন ফাটাফাটি ঝগড়া করতেন, সেটাও তার একটা হিসেবের ব্যাপার ছিল। সংসারের সমস্ত কিছু আপন হাতের মুঠোর ভেতর চেপে রাখতেন। এক চুল এদিক ওদিক হবার জো ছিল না। শুধু স্বামী নয়, মেয়ে থেকে চাকর-বাকর পর্যন্ত সবাই তার অনুগত ছিল। কাজের বেটি একচুল এদিক সেদিক করলে ঝাঁটা দিয়ে পিটিয়ে বাড়ির বের করে দিতেন। নিজের মেয়েটিকে পাড়ার কোনো ছেলের সঙ্গে হাসাহাসি করতে দেখলে পিটিয়ে আধমরা করে ফেলতেন।
গথিক ধাঁচে তৈরি এই প্রাসাদোপম স্বপ্নপুরিতে প্রবেশ করে নুরুন্নাহার বানুর মনে হয়েছিল তিনি মহারানীর কপাল নিয়ে জন্মগ্রহণ করেছেন। কিন্তু অতি অল্প সময়ের মধ্যেই তার ঠিকে ভুল হতে লাগল। ছোট খালে নৌকা বায় যে মাঝি, উত্তাল তরঙ্গসংকুল মহাসমুদ্রে এসে পড়লে তার যে অবস্থা হয়, নুরুন্নাহার বানুও সেরকম পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে লাগলেন। কাজের লোকদের নির্দেশ দিতে গিয়েই তার কর্তৃত্বের পরিধি কতদূর সংকুচিত টের পেলেন। মালিকে সামনে তরকারির বাগান করার হুকুম দিয়েছিলেন, মালি তার মুখের উপর বলেছে এই বাড়িতে সেটা চলতে পারে না। বেয়ারাকে দুপুরবেলা বাজারে গিয়ে কিছু টক দই কিনে আনতে বলেছিলেন, বেয়ারা ঘড়ি দেখে বলেছিল,
-বেগম সাহেবা আমার পরে যে আসবে তাকে বলবেন, আমার ডিউটি শেষ। এখন আমি বাসায় যাব।
এরকম ছোট ছোট ঘটনার মধ্য দিয়ে টের পাচ্ছিলেন এই বাড়িতে কেউ তাকে বিশেষ মান্য করার প্রয়োজন বোধ করে না।
তার চোখের সামনে আবু জুনায়েদ কী রকম বদলে গেল। আবু জুনায়েদের গেঞ্জি এবং জাঙ্গিয়া থেকে এত দুর্গন্ধ বের হতো যে নুরুন্নাহার বানুর বমি এসে যেত। তবু সেগুলো তিনি পাল্টাতেন না। এখন আবু জুনায়েদ বাড়িতেও অর্ধেক সময় থ্রি পিস স্যুট পরে বসে থাকেন। চেপে কথা বলবেন কি করে মানুষটাকেই অচেনা অচেনা লাগে। আগে ক্লাস থেকে ফিরতে পাঁচ মিনিট দেরি করলে নুরুন্নাহার বানুর কাছে দশ মিনিট কৈফিয়ত দিতে হতো। এখন পুরো একবেলা এমনকি কখনো একদিন একরাত বাড়িতে না এলেও নুরুন্নাহার বানুর কাছে কথা বলাটাও প্রয়োজন বোধ করেন না। এখন আবু জুনায়েদের ব্যক্তিগত সহকারী, একান্ত সচিব, চাপরাশি কত কিছু হয়েছে। বেলে টিপ দিলেই উর্দি পরা লোক ছুটে আসে। আবু জুনায়েদের নুরুন্নাহার বানুকে কীসের প্রয়োজন।
মেয়েটাও কি নুরুন্নাহার বানুর আছে! নুরুন্নাহার বানু নিজের চোখে দেখেছেন একটা আলগা বেটাকে ঘরে বিয়ে করা বউ আছে, ছেলেমেয়ে আছে, তাকে আপন বুকে হাত দিতে দিয়েছে। নুরুন্নাহার বানু যখন শাসন করতে গেছেন আপন পেটের মেয়ে চোখ রাঙিয়ে বলে কি, খবরদার গায়ে হাত দিতে আসবে না। আবেদ ভাইকে ভালো লাগে, তাই মজা করছিলাম। তুমি চিৎকার করলে আমি আবেদ ভায়ের কাছে চলে যাব। আবেদ ভাই বর্তমান বউকে নিয়ে সুখী নয়। আমিও যদি সুখী না হই সেটা আমার ব্যাপার। তুমি হৈচৈ করার কে?