-আমার ভাগ্যের চাকা ঘুরতে আরম্ভ করেছে। আসবে, আরো অনেকে আসবে । অনেককেই আসতে হবে। তারপর তিনি গোয়ালঘরে গরুকে ঘাস খাওয়াতে চলে গেলেন।
বিরোধী দলীয় ছাত্রনেতা মাজহারুল করিম জুয়েল যেদিন আবু জুনায়েদের সঙ্গে গোয়ালঘরে দেখা করতে এল তার মনের ভেতর কে যেন বলে দিল এই গোয়ালঘর থেকেই তোমার নতুন ক্যারিয়ার তৈরি হতে যাচ্ছে আবু জুনায়েদ। অনেকদিন পর্যন্ত তোমার সৌভাগ্য রাশি আলো দিতে থাকবে।
সেই সময়ে বিশ্ববিদ্যালয় দুদলের মারামারির কারণে অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। বিশ্ববিদ্যালয় যখন একেবারে বন্ধ হয়ে যায়, ক্যাম্পাসে কোনোও ছাত্রছাত্রী থাকে না, এ ধরনের পরিস্থিতিতে অ্যাকটিবিস্ট ছাত্রনেতারা বিপদে পড়ে যায়। এ ধরনের সময়কে তাদের জন্য আকালও বলা চলে। তাদের অনেককেই কষ্টেসৃষ্টে দিন কাটাতে হয়। কোনো কোনো সময় দুবেলার খাবারও জুটতে চায় না। অ্যাকটিবিস্ট ছাত্রনেতার সঙ্গে দলবল সাঙ্গপাঙ্গ না থাকলে শক্তিই বা কোথায় আর দাপটও বা আসবে কোত্থেকে। আর অ্যাকটিবিস্ট ছাত্রনেতার পেছনে জনশক্তি যদি থাকে তার মূল্য কী? একা একা দোকানে গিয়ে চাঁদা তোলার কথা দূরে থাকুক ভিক্ষেও করা যায় না।
বিশ্ববিদ্যালয় একেবারে বন্ধ থাকলে অ্যাকটিবিস্ট ছাত্রনেতারা এরকম অথৈ পানিতে পড়ে যায়। ঢাকায় যাদের বাড়িঘর আছে, তাদের কথা আলাদা। যারা মফস্বল থেকে এসেছে, যাদের বাড়ি একেবারে গ্রামে তাদের অবস্থা দাঁড়ায় হরিণবিহীন বনভূমিতে বন্দী ব্যাঘ মহারাজের মতো। উপস্থিত মুহূর্তে মাজহারুল করিম জুয়েলের অবস্থা একেবারে শোচনীয়। সে না পারছে গ্রামে ফিরে যেতে, না পারছে প্রকাশ্যে চলাফেরা করতে। ছিনতাই, রাহাজানি এবং খুনের অভিযোগে তার বিরুদ্ধে তিনটি মামলা রয়েছে। অবশ্য খুনের মামলায় তাকে ষড়যন্ত্রমূলকভাবে আসামী করা হয়েছে। জুয়েল যদি গ্রামে যায় চিল যেভাবে ছুঁ মেরে মুরগির বাচ্চা নিয়ে যায়, সেভাবে তাকেও পুলিশ উঠিয়ে নেবে। শহরে প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াবার উপায় নেই। জুয়েল দলের জন্য এতগুলো ঝুঁকি নিয়েছে, এতগুলো মামলার আসামী হয়েছে, আজকে যখন সে বিপদে পড়েছে দল তাকে গ্রহণ করতে চাইছে না, বের করে দেয়ার চক্রান্ত করছে। এখন মাজহারুল করিম জুয়েলের সামনে দুটি পথই খোলা আছে। প্রথমটি হলো সরকারি ছাত্র দলটিতে যোগ দেয়া। সরকারি দলে যোগ দিতে তার আপত্তি নেই, প্রধানমন্ত্রী যে নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করেছেন, সেগুলো তার ভীষণ পছন্দ। কিন্তু দুটি অসুবিধে : প্রথমটা হলো পুলিশ কেসগুলো উঠিয়ে * নিতে হবে। দ্বিতীয়টা হলো সরকারি দলের অ্যাকটিবিস্ট নেতা হান্নান মোল্লার সঙ্গে তার সম্পর্ক ভালো নয়। হান্নান মোল্লা যদি বাধা দেয় তাহলে একটু বেকায়দায় পড়ে যাবে। তবে সে গভীর রাতে হান্নান মোল্লার বাড়িতে গিয়ে কথাবার্তা বলে একটা ফয়সালা করে ফেলার আশা রাখে। যে দলেরই হোক না কেন অ্যাকটিবিস্ট ছাত্র নেতাদের একটি সাধারণ ধর্ম হলো একজন নেতা যদি আরেকজন অ্যাকটিবিস্ট নেতার কাছে আত্মসমর্পণ করে বসে, প্রাপ্য মর্যাদা দিতে কখনো কুণ্ঠিত হয় না । তার দৃঢ় বিশ্বাস সে সবগুলো বিপদ থেকে উদ্ধার পেয়ে যাবে। সরকারি দলের যুবনেতা বাটুল ভায়ের সঙ্গে তার ফাইনাল কথা হয়েছে। সবকিছু সে সাইজমতো সেটেল করে এনেছে প্রায়। উপস্থিত মুহূর্তে তার কিছু নগদ টাকার প্রয়োজন, সেজন্য উপাচার্য স্যারের কাছে আসা। তিনি যদি টাকাটা ম্যানেজ করে দেন। আবু জুনায়েদ জিজ্ঞেস করলেন,
-কত টাকা হলে তোমার চলে?
জুয়েল বলল, বেশি নয় স্যার মাত্র পনের হাজার।
শুনে আবু জুনায়েদের বোবা হয়ে যাওয়ার উপক্রম।
-অত টাকা আমি পাব কোথায়? মাইনে কত পাই জানো? জুয়েল বলল, স্যার আপনাকে এক টাকাও দিতে হবে না। আমার একটা লোক আছে সে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাফেটেরিয়ার ক্যাটারার হিসেবে নিয়োগপত্র পাওয়ার আবেদন করেছে, আর্নেস্টমানি জমা দিয়েছে, উপাচার্য স্যার যদি অনুগ্রহ করে ক্যাটারিংয়ের সুযোগটা তার বন্ধু রহমতউল্লাহকে দিয়ে দেন তার কাছ থেকেই সে পনের হাজার টাকা ক্যাশ আদায় করে নেবে। জুয়েল আরো বলল, কাজটা ঠিক হচ্ছে না সে জানে, তবু উপাচার্য সাহেবের কাছে একটি কারণে তার প্রার্থনাটি জানাতে এসেছে, কারণ উপাচার্য স্যার খুব নরম দিলের মানুষ। গরু ছাগল পাখি গাছপালা সবকিছুই তার দয়া পেয়ে থাকে। সে তুলনায় জুয়েল তো মানুষের বাচ্চা। অল্প কদিন আগেও বিরোধী ছাত্র সংগঠনের অ্যাকটিবিস্ট নেতা হিসেবে তার একটি সম্মানজনক অবস্থা ছিল। উপাচার্য স্যার যদি তাকে এই বিপদ থেকে উদ্ধার করে দেয়, সুদূর ভবিষ্যতে সে উপাচার্য স্যারের চাকর হওয়ার আশা পোষণ করে।
মাজহারুল জুয়েলের কথাবার্তা শুনে আবু জুনায়েদ একটু উন্মনা হয়ে পড়েছিলেন, একটা তন্ময়তাবোধ তাকে আচ্ছন্ন করেছিল। তিনি তন্ময়তা ভেঙে জেগে উঠে বললেন,
-একটি শর্তে তোমাকে সাহায্য করতে রাজি হব। বলো শর্তটি মানবে?
-স্যার আপনি যা বলবেন, তাতেই আমি রাজি।
-তোমাকে ভালো হয়ে যেতে হবে। কথা দিতে হবে গুণ্ডামি ষণ্ডামি এসব করবে ।
-স্যার আমি এখনই ভালো হয়ে গেছি। কথা দিচ্ছি কোনো বদ কাজ আমি করব না। বরঞ্চ যদি কাউকে অন্যায় কাজ করতে দেখি গুলি করে মাথার খুলি উড়িয়ে দেব।