ড. সাইফুল আলমকে আবু জুনায়েদের খোঁজ করতে হলো না। ড. আলমকে গেট পেরিয়ে ভেতরে ঢুকতে দেখামাত্রই আবু জুনায়েদ এগিয়ে গিয়ে নিয়ে এলেন । তিনি বললেন,
-ভাই হাত মেলাতে পারব না, কারণ হাতে অনেক কাদা।
ড. আলম বললেন,
-আপনার এই কাদামাখা হাতের সঙ্গে হাত মেলাবার জন্যই সকালবেলা ছুটে এলাম । দিন কাদামাখা হাতটা দিন, একটু মিলিয়ে নিই ।
অগত্যা আবু জুনায়েদ তার হাতখানি প্রসারিত করে দিলেন। হাত মেলানোর পালা সাঙ্গ হওয়ার পর আবু জুনায়েদ ড. সাইফুল আলমকে উপাচার্য ভবনে নিয়ে যেতে চাইলেন। ড. আলম বললেন, জুনায়েদ সাহেব এমন সুন্দর দিনে ঘরে কেবা যায়। চার দেয়ালের মধ্যে ঢুকতে মন চাইছে না। আবু জুনায়েদ বললেন,
-তাহলে বারান্দায় চেয়ার পেতে দিতে বলি।
ড. সাইফুল আলম জবাবে বললেন,
-সেটিও হচ্ছে না। তার চেয়ে আপনি আপনার গরু এবং পাখিগুলো দেখান। এত শুনেছি। দুজনে পথ দিয়েছেন, মাঝামাঝি জায়গায় গিয়ে ড. আলম আবু জুনায়েদের হাত ধরে থামিয়ে দিয়ে বললেন,
-কিন্তু ভাই একটি কথা, আপনাকে আগেই সোজাসুজি বলে ফেলতে চাই। পরে আমার বলতে খারাপ লাগবে, শুনে আপনারও মনে হতে পারে মানুষটা তোষামোদ করতে এসেছে।
আবু জুনায়েদ বললেন,
-ড. আলম আপনি আসুন। সেসব নিয়ে আপনাকে চিন্তা করতে হবে না। আপনার মতো স্ট্রেটফরোয়ার্ড মানুষ আমি খুবই কম দেখেছি।
আবু জুনায়েদ ড. সাইফুল আলমকে প্রথমে গরুটা দেখাতে নিয়ে গেলেন। গরু শুয়েছিল। আবু জুনায়েদরা প্রবেশ করার সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়িয়ে আদর করার জন্য ঘাড়টা বাড়িয়ে দিল। আবু জুনায়েদ আদর করলেন। তারপর মুখের কাছে ডান হাতটা বাড়িয়ে দিলেন। গরুটা লম্বা লালচে জিভ বের করে হাত চাটতে লাগল । ড. সাইফুল আলম পকেট থেকে চশমা বের করে চোখে লাগিয়ে ভালো করে গরুটা দেখলেন। গো সন্দর্শন শেষ করে দুজনে উত্তরের শেডে গিয়ে বসেছেন। খাঁচা থেকে দুটি ময়নার মধ্যে একটি কথা বলে উঠল : পরিবেশ বাঁচান, গাছ লাগান। ময়নার কণ্ঠস্বর শুনতে পেয়ে ড. আলম উঠে দাঁড়ালেন। তারপর প্রতিটি খাঁচার কাছে গিয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলেন। তার মধ্যে একটা চঞ্চলতা লক্ষ্য করা যাচ্ছিল। তিনি বলে উঠলেন,
-জুনায়েদ সাহেব, একটা কথা বলে ফেলি। আপনার কাছে আমি নির্বাচনে হেরেছি। জানেন তো প্রতিদ্বন্দ্বীর প্রতি একটা ঈর্ষা, একটা শত্রুতার ভাব সব সময়ে থাকে।
আবু জুনায়েদ মনে মনে শঙ্কিত হয়ে উঠলেন, কী জানি আবার ড. সাইফুল আলম কী অঘটন ঘটিয়ে তোলেন। কিন্তু ড. সাইফুল আলমের মুখ থেকে কোনো অপ্রিয় বাক্য তিনি শুনতে পেলেন না।
ড. সাইফুল আলম বললেন,
-জুনায়েদ সাহেব, আপনার কাছে নির্বাচনে হেরেছি, সেজন্য মনে একটা বেদনাবোধ ছিল, এই মুহূর্তে পাখির মুখের কথা শুনে আমার মনের সমস্ত বেদনা, সমস্ত দুঃখ কোথায় চলে গেল। আমি হেরেছি বটে, কিন্তু হেরেছি একজন যোগ্য এবং ডিসেন্ট মানুষের কাছে। আসুন একটু কোলাকুলি করি।
কোলাকুলির পর দুজনে মুখোমুখি বসলেন। চা এল, সন্দেশ এল। আবু জুনায়েদ এবং ড. সাইফুল আলম দুজনকেই উঠে হাত ধুতে হলো। সন্দেশ চা খেতে খেতে ড. সাইফুল আলম তার আগমনের কারণ ব্যাখ্যা করতে লেগে গেলেন,
-আমার গিন্নি আপনাকে সালাম দিয়েছেন। বস্তুত তিনিই জোর করে আপনার কাছে পাঠিয়েছেন। আপনি তো জানেন আমরা সাত চল্লিশের এ-তে থাকি। বাড়িটা তিন রুমের। আমাদের অনেকগুলো ছেলেমেয়ে। আমরা যখন বিয়ে করেছি তখনো ফ্যামিলি প্ল্যানিং-এর কথাটা বিশেষ গুরুত্ব পায়নি। কী করব ভাই, একবার ভুল করেছি এখন তো শোধরাবার উপায় নেই। তিন রুমের বাড়িতে সকলের স্থান সংকুলান হতে চায় না। ছেলে দুটোর বিয়ে দিয়েছি। তাদের বাচ্চা কাচ্চা হয়েছে । সকলকে গাদাগাদি করে এক সঙ্গে থাকতে হয়। তাই আমার গিন্নি বললেন, মুতালিব সাহেবরা চলে যাওয়ার পর থেকে আঠার বি-র চার রুমের ফ্ল্যাটটা খালি পড়ে রয়েছে। আপনি যদি ওই ফ্ল্যাটটা আমাদের দেয়া যায় কি না দেখতেন।
আবু জুনায়েদ কিছুক্ষণ চিন্তা করলেন, তারপর বললেন,
-আপনার ক্যালিবারের একজন মানুষ চার রুমের একটি বাসা চাইছেন, সেটা এমন কী। আপনার আসার প্রয়োজন ছিল না। কাউকে দিয়ে দুকলম লিখে পাঠালেই কাজ হয়ে যেত। তবে আপনি এসেছেন আমি খুব খুশি হয়েছি। তবে ভাই একটি কথা, ফ্ল্যাট তো আমি বরাদ্দ করব, কিন্তু আপনার দলের লোকদের দিকটা আপনি একটু খেয়াল রাখবেন। উনারা সবসময় আমার ভালো কাজের খারাপ মানে করেন।
ড. সাইফুল আলমকে একটু অপ্রস্তুত দেখা গেল। তিনি বললেন,
-হ্যাঁ ভাই সে কথাও তো ভাবতে হবে। আমি তো একটি দল করি। আর মোটামুটি প্রিন্সিপ্যাল একটা মেনে আসছি।
আবু জুনায়েদ চায়ের কাপে শেষ চুমুক দিয়ে গা ঝাড়া দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে দৃঢ়কণ্ঠে বললেন,
-হ্যাঁ ভাই চার রুমের ফ্ল্যাট আপনার নামে অ্যালটমেন্ট দেয়া হবে, আগামী মাসেই পজেশন নিতে পারবেন।
আরো কিছুক্ষণ গল্পগুজব করে ড. সাইফুল যাওয়ার জন্য উঠে দাঁড়ালেন। উত্তরের শেড থেকে বের হওয়ার আগে বললেন,
-ভাই এই মুহূর্তে স্থির করলাম, আমিও একটি ময়না পুষবো। পাখিটিকে একটি কথাই শেখাব-ডিসেন্ট শত্রুর কাছে হারাও ভালো ।
ড. সাইফুল আলম চলে যাওয়ার পর আবু জুনায়েদ কিছুক্ষণ চেয়ারে অচল হয়ে বসে রইলেন এবং বিড়বিড় করে বলতে থাকলেন,