-জুনায়েদ ভাই লোকমুখে শুনেছি আপনি একটা গাভী সংগ্রহ করেছেন এবং মিনি চিড়িয়াখানা গড়ে তুলেছেন। পরিবেশচর্চায়ও নাকি মনোযোগ দিতে আরম্ভ করেছেন। শুনে ভীষণ ভালো লাগল। ভালো জিনিস কার না পছন্দ হয়? আমার আগ্রহ এত প্রবল হলো, এই শীত বৃষ্টির মধ্যেই দেখতে ছুটে চলে এলাম। কই দেখান দেখি আপনার গাভী এবং অন্যান্য জীবজন্তু। আবু জুনায়েদ প্রথমে উত্তরের শেডে পাখির খাঁচাগুলো দেখালেন। আপনা থেকেই শিরওয়ানির মুখ থেকে বেরিয়ে গেল,
-বাহ্ চমৎকার অনেক জাতের পাখি আপনি সংগ্রহ করেছেন। জুনায়েদ ভাই, ইউ আর এ মিরাকল ম্যান।
শিরওয়ানি সাহেব একটু উঁচু হয়ে আবু জুনায়েদের কাঁধে হাত দিয়ে বললেন,
-এইবার আপনার গাভীটি দেখব।
আবু জুনায়েদ তাকে আসুন বলে একেবারে গোয়ালঘরের ভেতরে নিয়ে গিয়ে মশারি তুলে ফেললেন। গরুটা দেখে শিরওয়ানি সাহেবের চোখজোড়া কপালে উঠে গেল।
-জুনায়েদ ভাই কী করছেন, কোহিনূরের চাইতে দামি চীজ। এই জিনিস আপনি পেলেন কোথায়? যতই আপনাকে দেখছি অবাক হচ্ছি-আপনি বিস্মিত হচ্ছেন? তার কোনো কারণ নেই। শহীদ হোসেন শিরওয়ানি সিনেটে আপনার সমালোচনা করে। এটা তো ভাই নাগরিক কর্তব্য। আমাকে তা করতে হবে। কিন্তু সেটাই সব নয়। আমি মানুষটার আরেকটা পরিচয় আছে। আমি ভালো জিনিসের তারিফ করতে পারি। সে কারণে তো আপনার এখানে এলাম।
তারা দুজনে গোয়ালঘর থেকে বেরিয়ে এসে পাশাপাশি বসলেন। আবু জুনায়েদ শিরওয়ানি সাহেবের জন্য কফি এবং বিস্কুট আনালেন। কফির কাপে চুমুক দিতে দিতে শিরওয়ানি সাহেব তার পিতৃদেবের গল্প করলেন। তার পিতৃদেবও আবু জুনায়েদের মতো গরু পুষতে ভালবাসতেন। তারপর দেশের কথায় এলেন। দেশের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে দুঃখ প্রকাশ করলেন। দেশ গোল্লায় যেতে বসেছে। শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ে নয় সারা দেশের তারুণ্য অপচিত হতে যাচ্ছে। তারও দুজন তরুণ ছেলে আছে। একজন মাস্টার্স দিল আর একজন অনার্সে ভর্তি হয়েছে। তার খুব ভয় কখন মারা যাবেন । ছেলেদের একেবারে অসহায় অবস্থার মধ্যে ফেলে যেতে হবে। সারা জীবন দেশের কাজ করেছেন। নিজের চিন্তা করার সময় পাননি। এখন স্ত্রী এবং ছেলেদের সামনে মুখ তুলে কথা বলতে পারেন না। ইচ্ছে করলে কি না করতে পারতেন। তাকে ধরে কত লোক কোটিপতি হয়ে গেল। অথচ শিরওয়ানি সাহেবের কিছুই হয়নি। তিনি যে কিছু করতে পারেননি সেই মনোবেদনাটি প্রকাশ করতে আবু জুনায়েদের কাছে আসা। কারণ, তিনি বিশ্বস্তসূত্রে জানতে পেরেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ঠিকাদার শেখ তবারক আলী সম্পর্কে আবু জুনায়েদের চাচা শ্বশুর হন। শিরওয়ানি সাহেব মরবার আগে ছেলেদের একটা ছাদের তলায় রেখে যেতে চান। বর্তমানে বারিধারায় একটি ডেরা বানাবার চেষ্টা করছেন। প্রিনস পর্যন্ত না উঠলে তিনি হাউজ বিল্ডিংস থেকে লোন পাবেন না। এই কাজটুকু করার জন্য তার লাখ দুয়েক ইট দরকার। জুনায়েদ ভাই তার চাচা শ্বশুর তবারক সাহেবকে ছয় মাসের করারে দুলাখ ইট যদি তার ভাটা থেকে দিতে বলেন, একটি গরিব পরিবারের বড় উপকার হয় এবং জুনায়েদ এ কাজটুকু করে দেবেন, কারণ তিনি জানেন তার মনে দয়া আছে। কালিদাস আবৃত্তি করে শোনালেন, ‘জ্ঞানীতে অনুনয় নিষ্ফল সেও ভালো ছোটোলোকে বর দিলে নিতে নেই।’ আবু জুনায়েদ সঙ্গে সঙ্গে কবুল করে ফেললেন, তিনি তবারক সাহেবকে বলে দেবেন। শিরওয়ানি সাহেব চলে গেলে অস্ফুটে উচ্চারণ করলেন, ভাগ্যের চাকা আমার অনুকূলে ঘুরতে আরম্ভ করেছে।
ড. সাইফুল আলম বিগত উপাচার্যের প্যানেল নির্বাচনে বেগুনি দলের প্যানেলভুক্ত প্রার্থীদের একজন ছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র শিক্ষকদের মধ্যে ভালো মানুষ এবং ভালো শিক্ষক হিসেবে ড. আলমের সুনাম রয়েছে। তিনি যদি প্রাক্তন উপাচার্য আবু সালেহ্র সঙ্গে একই প্যানেলে না দাঁড়িয়ে ডোরাকাটা দলের প্রার্থী হতেন, সবচেয়ে বেশি ভোট পেতেন একথা আবু জুনায়েদও স্বীকার করেন। আবু জুনায়েদ মনে মনে ড. সাইফুল আলমকে খুব শ্রদ্ধা করেন। তাকে ডোরাকাটা দল থেকে প্রার্থী হওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছিল। তিনি সরাসরি তা প্রত্যাখ্যান করে বলেছিলেন, আমি জানি নির্বাচনে বেগুনি দল হারবে । তবু আমি ওই দলে থেকেই নির্বাচন করব । আপনারা হয়তো বলবেন, এটা আমার জন্য একটা বোকামো হবে । সবাইকে চালাক হতে হবে এমন কোনো কথা আছে কি? পৃথিবীতে কিছু মানুষ আছে ক্রমাগত হেরে যাওয়াই হচ্ছে যাদের কাজ। ক্রমাগত হারার ক্ষমতা অর্জন করাকেই আমি সবচেয়ে বড় বিজয় বলে মনে করি ।
ড. সাইফুল আলম একদিন সকালবেলা আবু জুনায়েদের গোয়ালঘরে এসে উদয় হলেন। সেটা ছিল কোনো একটা পর্ব উপলক্ষে ছুটির দিন। আবু জুনায়েদ বাগানে মালিদের সঙ্গে নিজ হাতে কাজ করছিলেন। এই অভ্যেসটি তিনি একেবারে হালে রপ্ত করেছেন। দলের লোকেরা যখন থেকে পরিবেশ-প্রেমিক হিসেবে তার একটি নতুন পরিচয় প্রকাশ পেতে আরম্ভ করেছেন, তারপর থেকে আবু জুনায়েদ ফুল ফল গাছপালা এসবের প্রতি বর্ধিত অনুরাগ প্রকাশ করতে আরম্ভ করেছেন। একদল ছাত্রকে তিনি বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় গাছের চারা লাগাবার জন্য বিশেষ তহবিল থেকে দশ হাজার টাকা দিয়েছেন। অবশ্য বেগুনি দলের লোকেরা আবু জুনায়েদের এই একান্ত ভালো কাজটিকেও খারাপভাবে সকলের সামনে তুলে ধরেছেন। তারা বলেছেন সরকারি দলটির মাস্তানদের হাতে রাখার জন্য বৃক্ষরোপণের নামে টাকাটা তাদের পাইয়ে দিয়েছেন।