ড. আজিম পিনপতন নিস্তব্ধতার মধ্যে লিফলেটের খসড়াটি পাঠ করে গেলেন। শেষ হলে সকলেই একবাক্যে বললেন, চমৎকার। আবু জুনায়েদ ড. আজিমের দিকে প্রথম নতুন চোখে তাকাতে আরম্ভ করলেন। তার কর্মের মধ্য থেকে একটা জীবনদর্শন আবিষ্কার করা রীতিমতো সেয়ানা মস্তকের কাজ। ঠিক করলেন প্রফেসর পদে তার প্রমোশন দেয়া যায় কি না চেষ্টা করে দেখবেন। সেদিন সন্ধ্যেবেলা উপাচার্য সাহেব দোকান থেকে বিরিয়ানি আনিয়ে সকলকে খাওয়ালেন। একেবারে তার নিজের একটি দল তৈরি হয়ে গেল।
১৩-১৫. আবু জুনায়েদের গোয়ালঘর
কিছুদিন যেতে না যেতেই আবু জুনায়েদের গোয়ালঘর নিরন্তর কর্মতৎপরতার কেন্দ্র হয়ে দাঁড়ালো। শুধু সন্ধ্যেবেলা নয়, ছুটির দিনে, কর্মচারিদের কর্মবিরতির দিনে কিংবা ছাত্রদের ডাকা ধর্মঘটের দিনগুলো সকালবেলাতে এ গোয়ালঘরে নানারকম বৈঠক বসা শুরু হয়ে গেল। ডোরাকাটা দলের সকলে আবার এখন আবু জুনায়েদকে সমর্থন করেন না। কিছু বেগুনি দলে চলে গেছেন, কিছু হলুদ দলে যাব যাব করছেন। আগামীতে হলুদ দলটি শক্তিশালী হয়ে উঠবে তার যাবতীয় আলামত দেখা যাচ্ছে। আবু জুনায়েদ তার নতুন সমর্থক মণ্ডলীদেরসহ ডোরাকাটা দলের অবশিষ্টাংশ নিয়ে একটি নতুন দল করবেন কি না ভেবে দেখছেন। যদি ভবিষ্যতে তেমন পরিস্থিতি আসে, তিনি হাত গুটিয়ে বসে থাকতে পারবেন না।
এই বাদ প্রতিবাদ, এই অনবরত বাকযুদ্ধ, এই লিফলেট, পাল্টা লিফলেট বিতরণ এসবের মধ্য দিয়ে আবু জুনায়েদের গরুটির কথাই প্রচারিত হলো সর্বাধিক। বিশ্ববিদ্যালয়ের একেবারে সাধারণ ছাত্রছাত্রীরা গরুবিষয়ক অনেক খবরাখবর জেনে গেল। শ্রবণসুখকর নয় এমন সব মুখরোচক গুজবও তৈরি হতে থাকল। ছাত্রদের মধ্যেও উপাচার্যের পক্ষে-বিপক্ষে জনমত তৈরি হতে থাকল। বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় উপাচার্যের গাভী একটা চমৎকার শ্লেষাত্মক শব্দবন্ধ হিসেবে পরিচিতি পেয়ে গেল । যখন কোনো ছাত্র কোনো ছাত্রকে ইয়ার্কি করে তখন বলে বসে তুই বেটা উপাচার্যের গাভী । শ্লেষ প্রকাশে, অবজ্ঞা প্রকাশে নির্মল রসিকতায় উপাচার্যের গাভী শব্দবন্ধের ব্যাপক ব্যবহার চালু হয়ে গেল। উপাচার্যের গাভী শব্দবন্ধ অল্প কিছুদিনের মধ্যেই তরুণ ছাত্রছাত্রীদের নানান ধরনের ভাব প্রকাশের মাধ্যম হয়ে দাঁড়ালো।
উপাচার্যের গাভী শব্দবন্ধের অপব্যবহারকে কেন্দ্র করে দুদল ছাত্রের মধ্যে একটা জবরদস্ত মারামারি হয়ে গেল। সময়মতো পুলিশ এসে না পড়লে খুনোখুনি হয়ে যেত। ঘটনাটি ঘটেছিল এভাবে। একজন সুন্দরী ছাত্রী তার পুরুষ বন্ধুকে নিয়ে কৃষ্ণচূড়া গাছের তলায় হাত ধরাধরি করে নিরিবিলি আলাপ করছিল। আরেকজন ফাজিল মতো ছাত্র এই মধুর দৃশ্য দেখে স্বতঃস্ফূর্তভাবে চিৎকার করে উঠল, লে হালুয়া উপাচার্যের গাভী। মন্তব্যটি সুন্দরী মেয়েটির কানে গিয়েছিল। মেয়েটি একেবারে ধনুকের টানটান ছিলার মতো সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে ছেলেটিকে প্রশ্ন করে বসল, কী বললে তুমি? ছেলেটি প্রথমে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গিয়েছিল। এতটুকু সে আশা করেনি। মুখরক্ষার জন্য বলল, যা বলবার তো বলে ফেলেছি। তুমি চেতছো কেন? বাদানুবাদের এই পর্যায়ে তার পুরুষ বন্ধুটি তেড়ে এসে তার মুখে খুব জোরে একটা চড় বসিয়ে দিল। ছেলেটিও পাল্টা ঘুষি দিতে গেল। কিন্তু সে ছিল গায়ে গতরে একেবারে দুর্বল। মেয়েটির বন্ধুটি তাকে কিলঘুষি দিতে দিতে একেবারে রক্তাক্ত করে ছাড়ল। ছেলেটির তিনচারজন বন্ধুবান্ধব ক্যাফেটেরিয়ার পাশে দাঁড়িয়ে গল্প করছিল। তার করুণ অবস্থা দেখতে পেয়ে ওপক্ষের ছেলেটাকে আক্রমণ করে বসল। তারও বন্ধুবান্ধব ছিল। তারা বন্ধুকে রক্ষা করতে ছুটে এল। ব্যস দুদলে একটা খণ্ডযুদ্ধ আরম্ভ হয়ে গেল। পনের বিশ মিনিটের মধ্যেই মারামারিটার একটা রাজনৈতিক আকার পেয়ে গেল। দুজন ছাত্ৰই দুটি প্রধান ছাত্রসংগঠনের হোমরাচোমরা। ছাত্রাবাসে ছাত্রাবাসে খবর রটে গেল। দলে দলে দুই দলের সৈনিকেরা শহীদ হওয়ার আবেগ নিয়ে একদল অন্যদলের বিরুদ্ধে ইট বৃষ্টি করতে লাগল। কাটা রাইফেল এল, রিভলবার এল, রামদা এল। চীনা কুড়ালের ফলায় সূর্যের আলো ঝকমক জ্বলে উঠল ।
একদিন মাঘ শেষে খুব বৃষ্টি হয়েছিল। গোয়াল ঘরের আড্ডায় কোনো লোক আসেনি। আসবে কেমন করে-মাঘের শীতের চাইতে মেঘের শীত অনেক বেশি। আবু জুনায়েদ একা একা বসে গরুটার পেটের কাছে হাত দিয়ে গর্ভস্থ শিশুটির নড়াচড়া অনুভব করা যায় কি না পরখ করে দেখছিলেন। এমন সময়ে তিনি কাকের আওয়াজের মতো একটা কর্কশ গলা খাকারি শুনতে পেলেন। আবু জুনায়েদ তাকিয়ে দেখেন উত্তর দিকের শেডে একটা বেঁটেমতো মানুষ দাঁড়িয়ে আছেন। তার শরীর ওভারকোটে ঢাকা। গলায় মাফলার পেঁচানো। চট করে আবু জুনায়েদের মনে পড়ে গেল এই শহরে সুযোগ পেলে ওভারকোট পরে বেড়ায় এমন মানুষ একজন আছেন তিনি হলেন শহীদ হোসেন শিরওয়ানি। শিরওয়ানি সাহেব বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেটের সদস্য। সাম্প্রতিককালে বিরোধী দলের রাজনীতির সঙ্গে তার খুব ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। সিনেটের অধিবেশনের সময় একাধিকবার আবু জুনায়েদকে একরকম উলঙ্গ করে ছেড়ে দিয়েছেন। আবু জুনায়েদ শহীদ হোসেন শিরওয়ানিকে কিছু বলার আগে নিজের মনকেই জিজ্ঞেস করলেন, শিরওয়ানি সাহেব মাঘ মাসের এই প্রচণ্ড শীত বৃষ্টিকে উপেক্ষা করে কোন প্রয়োজনে তার গোয়ালঘরে আসবেন। আবু জুনায়েদ উত্তরের শেডে এসে শিরওয়ানি সাহেবের মুখমণ্ডল ভালো করে তাকিয়ে দেখলেন। তার মুখে রসুনের শেকড়ের মতো না কামানো পাকা দাড়ি দেখতে পেলেন। শিরওয়ানি সাহেবই প্রথম কথা বললেন, ‘জুনায়েদ ভাই’। আবু জুনায়েদের বিস্ময়বোধ মাত্রা ছাড়িয়ে যাচ্ছিল । শিরওয়ানি সাহেবকে জীবনে এই প্রথম জুনায়েদ ভাই ডাকতে শুনলেন। তার মতলবটা কী তিনি আঁচ করতে চেষ্টা করছিলেন। যা হোক, শিরওয়ানি সাহেব বলে গেলেন,