এই লিফলেটের কয়েকটি কপি যথারীতি গোয়ালঘরের সান্ধ্য আসরে এসে পৌঁছাল। আড্ডায় রীতিমতো একটা চাঞ্চল্য সৃষ্টি হলো। সকলেরই একটা প্রশ্ন। এরকম নোংরা কর্ম কে বা কারা করতে পারে। সকলেরই ধারণা গাছের গুঁড়ি অলাদের সঙ্গে এই লিফলেটের একটা সম্পর্ক অবশ্যই আছে। ড. দেলোয়ার হোসেন নিশ্চিত করে বললেন,
-ড. আহমদ তকির উস্কানিতেই এই লিফলেট ছাড়া হয়েছে। তকি সাহেবের সার্ভিস এক্সটেনশনের আবেদনপত্রে উপাচার্য সাহেব সুপারিশ করেননি বলেই তার বিরুদ্ধে তিনি উঠে পড়ে লাগতে এসেছেন।
দর্শন বিভাগের আয়েশা খানম ড. দেলোয়ার হোসেনের মুখের কথা টেনে নিয়ে মন্তব্য যোগ করলেন,
-উপাচার্য সাহেব যদি একটিও ভালো কাজ করে থাকেন, আমার মতে সেটি হলো ড. তকির সার্ভিস এক্সটেনশনের আবেদনে সুপারিশ না করা। ড. তকি একজন ঘোরতর নাস্তিক-সেটা যথেষ্ট নয়, তিনি মাস্তান শিক্ষকদের নেতাও বটে। ফার্মেসী বিভাগের ড. ফারুক আহমদ একটু ভিন্নরকম কথা বললেন। তার মতে :
-এই লিফলেটের সঙ্গে ড. আহমদ তকির একটা সম্পর্ক আছে অস্বীকার করার উপায় নেই। তবে আমার বিশ্বাস ভাষাটা তকি সাহেবের নিজের নয়। তকি সাহেব গদ্য লেখার সময় তৎসম শব্দের অপপ্রয়োগ করেন এবং তার যে কোনো লেখায় স্নিক প্রত্যয়ান্ত শব্দ অবশ্যই থাকতে বাধ্য। আপনারা লিফলেটটি আবার পড়ে দেখুন, সেরকম একটি শব্দও খুঁজে পাবেন না। আমার বিশ্বাস এই লিফলেটটির লেখার সঙ্গে কোনো মহিলার হাত অবশ্যই আছে। রচনার রীতি দেখে মনে হয় লিফলেটটি রচনা করে থাকবেন দিলরুবা খানম।
উপস্থিত সকলের মতামতও তাই। হ্যাঁ দিলরুবা খানমের কলম থেকে এরকম একটি লিফলেট জন্ম নিতে পারে। বোটানি বিভাগের ড. মাহমুদুল আলম গম্ভীরভাবে বললেন,
-এই লিফলেট কে লিখেছেন বা কারা লিখেছেন সেটি বিচার্য বিষয় নয়। আমার কথা হলো এই নোংরা লিফলেটের একটি সুন্দর পরিচ্ছন্ন জবাব দেয়া প্রয়োজন। বুঝিয়ে দেয়া উচিত বিশ্ববিদ্যালয় নোংরামির জায়গা নয়। উপাচার্যের দিকে তাকিয়ে বললেন, কী বলেন স্যার?
আবু জুনায়েদ চশমার কাঁচ মুছতে মুছতে জবাব দিলেন,
-আমি কী বলব। বিশ্ববিদ্যালয় আপনাদের, আপনারা যা উচিত মনে করেন, করবেন।
সর্বসম্মতিক্রমে স্থির হলো অত্যন্ত রুচিসম্মত ভাষায় এই লিফলেটটির একটি জবাব দেয়া হবে। সেটি লেখার ভার বাংলা বিভাগের অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর ড. আনোয়ারুল আজিমের উপর দেয়া হলো। তিনি আগামী কাল সন্ধ্যেবেলা খসড়াটি করে আনবেন কথা দিলেন।
পরের দিন সন্ধ্যেবেলা গোয়ালঘরের সান্ধ্য আসরে সকলে অধীরভাবে প্রতীক্ষা করছেন। কিন্তু ড. আজিমের দেখা নেই। সকলের উল্কণ্ঠা বেড়ে গেল। ড. দেলোয়ার হোসেন বিরক্ত হয়ে বললেন,
-ড. আজিম পারবেন না বললেই হতো। না হয় বাংলা একটু কম জানি। তবু তো চেষ্টা করে দেখা যেত।
ড. আয়েশা খানম মন্তব্য করে বসলেন,
-খোঁজ নিয়ে দেখেন গিয়ে হয়তো ড. আহমদ তকির খপ্পরে পড়ে গেছেন। এক সময় তো আজিম তকি সাহেবের পেছনে ছায়ার মতো ঘোরাঘুরি করতেন।
মাওলানা আবু তাহের বললেন,
-সে তো চাকরি পাবার পূর্বের ঘটনা। এখন জমানা পাল্টে গেছে। একটু অপেক্ষা করুন। দেখেন আসবেন।
সত্যি সত্যি ড. আজিম এলেন। লিফলেটের খসড়াটি তার হাতে ধরা রয়েছে। তিনি কৈফিয়তের ভঙ্গিতে বললেন,
-আমি দুঃখিত। একটু দেরি হয়ে গেল। তিন চারবার কপি করতে হলো কিনা।
দেলোয়ার হোসেন সাহেব বললেন, আপনাকে আর ভণিতা করতে হবে না। কী লিখে এনেছেন পড়ে ফেলুন।
ড. আজিম জামার খুটে কাঁচ মুছে মুছে চশমাটি নাকের ডগায় চড়ালেন। প্রথমে একটা গলা খাকারি দিলেন। তারপর লাজুক ভঙ্গিতে বললেন,
-আমাদের লিফলেটেরও একটা শিরোনাম দেয়া হয়েছে। আর সেটা হলো মহান উপাচার্য : বৈপ্লবিক দৃষ্টিভঙ্গি।
মাওলানা তাকে বললেন, চমৎকার পড়ে যান।
ড. আজিম আবার একটু ভণিতা করলেন,
-আমি গোটা লিফলেটটি সাধু ভাষাতেই রচনা করিয়াছি। সাধু ভাষার একটা বিশেষ প্রসাদগুণ রয়েছে।
ড. ফারুক আহমদ একটু অধৈর্য হয়ে উঠছিলেন। তিনি বললেন,
-ড. আজিম লেখাটা পড়ে যান। পরে গুণাগুণ বিচার করব, আমরা শিশু নই।
অতএব ড. আনোয়ার আজিম পড়তে আরম্ভ করলেন :
-জগৎ পরিবর্তনশীল। কাল সহকারে কত কিছুরই পরিবর্তন হইতেছে। দিবস আঁধারে মিলাইতেছে, নদী সমুদ্রে পড়িতেছে। রাজ্য ও সাম্রাজ্য বিনষ্ট হইতেছে, আবার নতুন রাজ্য গড়িয়া উঠিতেছে। শিশু কিশোর হইতেছে, কিশোর যুবক হইতেছে এবং বৃদ্ধ মৃত্যুর মুখে ঢলিয়া পড়িতেছে। সুতরাং দেখা যাইতেছে পরিবর্তন জগতের ধর্ম। যে কেহ পরিবর্তনকে মানিয়া লইবে না সে আপনার মৃত্যুর পথ আপনি প্রশস্ত করিবে আপনার কবর আপনি খনন করিবে।
জাতীয় জীবনে আমাদিগকে এত দুর্ভাগ্যের বোঝা বহন করিয়া বেড়াইতে হইতেছে, তার মূল কারণ কী হইতে পারে? কারণ একটাই। আমরা পরিবর্তনকে মানিয়া লই নাই। আমাদের প্রাণপ্রিয় বিশ্ববিদ্যালয়ে এত অত্যাচার, এত অন্যায়, এত খুন, এত জীবনের অপচয়, সময়ের অপচয়, অর্থের অপচয় কেন অহরহ ঘটিতেছে তার কারণ কি কেহ চিন্তা করিয়া দেখিয়াছেন কি? ঐ একটাই কারণ জাতীয় জীবনের মতো বিশ্ববিদ্যালয়েও আমরা পরিবর্তনকে মানিয়া লই নাই । তাহার ফল এই হইয়াছে যে বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থা অধঃপতনের চরম সীমায় আসিয়া ঠেকিয়াছে। ব্রিটিশ সাম্রাজ্য বিদায় লইয়াছে, পাকিস্তানিরা চলিয়া গিয়াছে। কিন্তু আমরা ব্রিটিশ এবং পাকিস্তানিদের সমস্ত নিয়মকানুন আঁকড়াইয়া ধরিয়া রহিয়াছি। ব্রিটিশ আমলে উপাচার্যেরা যে ধরনের কর্মকাণ্ডের অনুষ্ঠান করিতেন, সেইভাবে জনবিচ্ছিন্নভাবে গজদন্ত মিনারে অবস্থান করিয়া ক্ষমতার মহিমা এবং স্বাতন্ত্র প্রকাশ করিতেন, পাকিস্তানি আমলের উপাচার্যেরা সেই জীবন পদ্ধতির অক্ষম অনুকরণ করিয়াছেন। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর পাকিস্তানি আমলের উপাচার্যদের অনুকরণ করিয়াছেন। এই পৌনঃপুনিক অনুকরণের কারণে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় অনেকদিন পর্যন্ত মৌলিক চিন্তাশক্তিসম্পন্ন কোনো বাংলাদেশী উপাচার্যের নিকট হইতে সঠিক দিক নির্দেশনা লাভ করিতে পারে নাই। স্বাধীনতার পর হইতে বেগুনি দলটি নানারকম তালবাহানা করিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ক্ষমতা কুক্ষিগত করিয়া রাখিয়াছিল। তাহারা নিজেদের স্বার্থেই পরিবর্তনের স্রোত রুদ্ধ করিয়া রাখিয়াছেন। এই পরিবর্তনকে ঠেকাইতে গিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাভাবিক জীবনপ্রবাহকে কলুষিত করিয়া ফেলিয়াছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে এত অনিয়ম হইতেছে, এত অন্যায় হইতেছে, এত খুন হইতেছে, এত সেশনজট হইতেছে, জীবনের এত অপচয় হইতেছে সবকিছুর জন্য বেগুনি দলই দায়ী। ডোরাকাটা দল তাহাদের অন্যায় অবিচার সংশোধন করিয়া এই বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি আদর্শ পরিবেশ সৃষ্টি করিবার জন্য সদাসর্বদা তৎপর রহিয়াছে। তাহাদের মনোনীত উপাচার্য মিয়া মুহম্মদ আবু জুনায়েদ সাহেব কোনোরকম দ্বিধা দ্বন্দ্ব না করিয়া ঔপনিবেশিক আমলের উপাচার্যের জীবন পদ্ধতি প্রত্যাখ্যান করিয়াছেন। তিনি একেবারে আমাদের দেশের সাধারণ মানুষের জীবনের একই সমতলে নামিয়া আসিয়াছেন। তিনি গাছপালা পশুপাখির মধ্যে জীবনের পূর্ণতা এবং সার্থকতা আবিষ্কার করিতে তৎপর হইয়া উঠিয়াছেন। ইহা কি একটি মহান বৈপ্লবিক দৃষ্টান্ত নয়? অতীতে কোন উপাচার্য সাজানো-গোছানো অফিসের মায়া ছাড়িয়া একজন সরল গ্রামীণ মানুষের মতো একটি চালঘরে নিজের দপ্তর প্রতিষ্ঠিত করিয়া গবাদি পশুর সঙ্গে, বিহঙ্গের সঙ্গে জীবন এবং কর্তব্য ভাগ করিয়া লইয়াছেন। যাহাদের দৃষ্টি নীচ তাহারা সর্বত্র নীচতা দেখিতে পাইবেন তাহাতে আশ্চর্য হইবার কিছুই নাই। বর্তমান বিশ্বে সর্বত্র পরিবেশ রক্ষার আওয়াজ বুলন্দ হইয়া উঠিয়াছে। আধুনিক পৃথিবীর সভ্য মানুষের পরিবেশ রক্ষার উদাত্ত আহ্বান তাহাদের মর্মে প্রবেশ করে নাই। তাহারা মধ্যযুগের অন্ধকারে চক্ষু আবৃত করিয়া রাখিয়াছেন, দিনের আলোক দেখিতে পাইতেছেন না। প্রকৃতি মানুষের একার নয়। মানুষকে পশুপাখি, গাছপালার সঙ্গে প্রকৃতি সমানভাবে ভাগ করিয়া লইতে শিক্ষা করিতে হইবে। এইটাই হইল সভ্যতার মর্মবাণী। আবু জুনায়েদ সাহেব বাংলাদেশের শতকরা পঁচাশি জন কৃষিজীবী মানুষের জীবনের সঙ্গে সহমর্মিতা প্রকাশ করিবার জন্য অনেক কষ্ট করিয়া একটি গবাদি পশুকে আদর করিয়া পুষিতেছেন। পরিতাপের বিষয় হইল বেগুনি দলের লোকেরা তাহার এই দৃষ্টান্তমূলক কর্মটির অপব্যাখ্যা করিতেছে। দেশের মানুষ ভালো করিয়া জানে কে বন্ধু, কে শত্রু। আমাদের জীবনের একমাত্র অবলম্বন গরুকে লইয়া যাহারা ব্যঙ্গ করে, দেশের মানুষ তাহাদের চিনিয়া লইতে ভুল করিবে না। সুতরাং আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রী, শিক্ষক কর্মচারী এবং কোটি কোটি দেশবাসীর পক্ষ হইতে বলিব, মহান আবু জুনায়েদ আপনি আপনার বৈপ্লবিক জীবনদর্শন লইয়া আগাইয়া চলিতে থাকুন, আমরা সকলে আপনার পেছনে রহিয়াছি।