-কী করে সম্ভব স্যার।
-বৎস তুমি সরল জিনিসটি বুঝিতে পারিলে না। তুমি বাড়ি হইতে টেলিফোন যন্ত্রের শাখা অত্র স্থানে টানিয়া আনার হুকুম করো। বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজকর্মও এইখানে বসিয়া তুমি সম্পন্ন করিতে পারিবে । জায়গাটি অতীব মনোরম। গাভীটি তো অনিন্দ্যসুন্দর । বিহঙ্গগুলির কলকাকলি শুনতেও বেশ লাগে। আধারাত কাজ করিলেও শরীরে মনে কোনো শ্রান্তি অনুভব করিবে না। আমরা যেমন প্রত্যহ আসিয়া থাকি, বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মে যাহারা তোমার দর্শন লাভ করিতে চায়, তাহারাও এখানে আসিবে। তুমি হুকুম করো।
জনার্দন চক্রবর্তীর ঝুনো মস্তকে এরকম সুন্দর একটি পরামর্শ লুকিয়ে থাকতে পারে, কেউ স্বপ্নেও ভাবতে পারেননি। মাওলানা তাহের বললেন,
জনার্দন বাবু একটি চমৎকার প্রস্তাব করেছেন। ওল্ড মানে গোল্ড এই কথা প্রমাণিত হলো। দুনিয়াতে বুড়ো মানুষের প্রয়োজন ফুরিয়ে যাবে না। বাদশাহ সিকান্দার জঙ্গে যাওয়ার সময় একদল বুড়ো মানুষ সঙ্গে সঙ্গে রাখতেন। কোনো বিপদ আপদ হলে তারা মুশকিল আসানের পথ বাতলে দিতেন, একবার হলো কী জানেন…?
আয়েশা খানম মাওলানা তাহেরের মুখ থেকে কথা কেড়ে নিয়ে বললেন, তারপর আপনি একটা গল্প শুরু করলেন। কিন্তু আমরা চাই আগামী কালই টেলিফোনের এক্সটেনশন লাইন নিয়ে আসা হোক। দুচারদিনেই গোয়ালঘরের উত্তরের শেডে টেলিফোনের এক্সটেনশন নিয়ে আসা হলো। টেবিল পাতা হলো। কোণার দিকে দুটো শেলফ বসে গেল। গোয়াল ঘরে উপাচার্যের একটা নতুন অফিস তৈরি হয়ে গেল। বিশ্ববিদ্যালয়ের খুচরোখাচরা কাজগুলো মিয়া মুহম্মদ আবু জুনায়েদ নতুন অফিসে বসেই সারতে লাগলেন। অনানুষ্ঠানিকভাবে যারাই দেখা করতে আসেন, তাদেরকে উত্তরের শেডে আসতে বলা হলো। মোগল সম্রাটেরা যেমন যেখানে যেতেন রাজধানী দিল্লিকে সঙ্গে করে নিয়ে যেতেন, তেমনি আবু জুনায়েদও দিনে একবেলার জন্য গোটা বিশ্ববিদ্যালয়কে গোয়ালঘরে ঢুকিয়ে ফেলতেন। দিনে দিনে গোয়ালঘরটাই বিশ্ববিদ্যালয়ের হৃৎপিণ্ড হয়ে উঠল। সেদিক দিয়ে দেখতে গেলে এটাই পৃথিবীর একমাত্র গোয়ালঘর, যেখান থেকে আস্ত একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মপদ্ধতি পরিচালিত হয়।
আর কিছুদিন না যেতেই গোটা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় একটা চাঞ্চল্যকর সংবাদ ছড়িয়ে গেল। উপাচার্য সাহেব বিকেলবেলা গোয়ালঘরে বসেই বিশ্ববিদ্যালয়ের নানা কাজকর্ম পরিচালনা করে থাকেন। তার গরু এবং মিনি চিড়িয়াখানা সম্বন্ধেও নানারকম আজগুবি খবর ছড়িয়ে পড়তে থাকল। এটাকে ঠিক গরু বলা যাবে কি না সে ব্যাপারেও বিতর্ক আছে। গরুটির গর্ভধারিণী হলো সুন্দরবনের একটা শিঙাল মাদি হরিণ এবং বাবা অস্ট্রেলিয়ান ষাঁড়। মাদী হরিণের গর্ভে এবং অস্ট্রেলিয়ান ষাঁড়ের ঔরসে উপাচার্য সাহেবের গরুটি পয়দা হয়েছে। গরুটির আকার প্রকার গরুর মতো। গায়ের রঙ, চোখের দৃষ্টি, স্বভাবের চঞ্চলতা সবটা হরিণের মতো। গরুটি এই অল্প সময়ের মধ্যে উপাচার্য সাহেবের কলিজার টুকরো হয়ে দাঁড়িয়েছে। একদণ্ড দৃষ্টির আড়াল করতে চান না। নিজের হাতে উপাচার্য সাহেব গরুটিকে খাওয়ান, নিজে গোসল করান, সাধ্যমতো মলমূত্রও নিজে পরিষ্কার করেন। অন্য কাউকে গরুটির ধারেকাছেও ঘেঁষতে দেন না।
এটাই একমাত্র গুজব নয়। গরুটাকে কেন্দ্র করে আরো একটা কাহিনী বিশ্ববিদ্যালয়ের নিম্নশ্রেণীর কর্মচারী এবং মহিলা মহলে চালু হয়ে গেছে। একটা জিন কিংবা পরীর সঙ্গে উপাচার্য আবু জুনায়েদের গভীর ভালবাসা হয়েছে। এই পরীটাই দিনের বেলা সুন্দর একটা গরুর বেশ ধরে গোয়ালঘরে শুয়ে থাকে। রাত গম্ভীর হলে অনিন্দ্যসুন্দর একটা মেয়ে মানুষ হয়ে আবু জুনায়েদের সঙ্গে রঙ-ঢঙ মতো কিছু করে। আবু জুনায়েদ রাতে ঘরে থাকেন না। পরী কন্যার সঙ্গেই গোটা রাত আশনাই করে কাটিয়ে দেন। এখন আবু জুনায়েদের সঙ্গে তার বড় পত্নী নুরুন্নাহার বানুর কোনো সম্পর্ক নেই। স্বামী স্ত্রীতে কথা বলা পর্যন্ত বন্ধ। তৃতীয় আরেকটি গুজব টিচার্স ক্লাবে তৈরি হয়েছে। তার মধ্যে বিশেষ চমৎকারিত্ব নেই। নিতান্ত সাদামাঠা ধরনের। সেটা এরকম-আবু জুনায়েদ নাকি স্থির করেছেন, উপাচার্যের চাকরির মেয়াদ ফুরোলে তিনি দুধের ব্যবসা করবেন। কারণ তিনি হিসেব করে দেখেছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করার চাইতে গাভী পুষে গয়লাগিরি করা অনেক লাভজনক।
কিছুদিন বাদেই নিউজপ্রিন্টে ছাপা একটি লিফলেট হাতে হাতে তামাম বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় ছড়িয়ে গেল। লিফলেটের শিরোনাম দেয়া হয়েছে উপাচার্য না গো আচার্য। কারা এই লিফলেট ছেপেছে, কারা বিলি করেছে তার কোনো উল্লেখ নেই। মূল বয়ানটা এরকম- ছাত্রছাত্রী, শিক্ষক-শিক্ষিকা, বিশ্ববিদ্যালয়ের সচেতন কর্মচারী এবং দেশপ্রেমিক দায়িত্বশীল নাগরিকবৃন্দের কাছে আকুল আবেদন : আপনাদের কাছে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের গরীয়ান ঐতিহ্যের কথা অজানা থাকার কথা নয়। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের চাইতে বাংলাদেশের গর্ব করার সম্পদ দ্বিতীয়টি নেই। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র শিক্ষকেরা এই অঞ্চলে একটি নতুন ইতিহাসের ভিত্তিভূমি রচনা করেছে। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের গর্ভ থেকে বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রাম জন্ম নিয়েছে। এই বিশ্ববিদ্যালয় জ্ঞান-বিজ্ঞান মেধা মনীষায় একদা সমস্ত ভারতবর্ষে একটা বিশিষ্ট স্থান দখল নিয়েছিল। মাননীয় শিক্ষক-শিক্ষিকা, ছাত্রছাত্রী ভাইবোনেরা, সম্মানিত দেশপ্রেমিক নাগরিকবৃন্দ আপনারা সকলে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বর্ণোজ্জ্বল গৌরবমণ্ডিত দিনের কথা স্মরণ করে অশ্রুপাত করুন। আজকের দিনে বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই অতীত দিনের গৌরবের লেশমাত্রও অবশিষ্ট নেই । বিশ্ববিদ্যালয়ে হরদম খুনাখুনি হামলাহামলি চলছে। নিয়মিত ক্লাস বসছে না, পরীক্ষা হতে পারছে না, সেশনজট লেগে আছে। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করে বেরুতে ছেলেদের চাকরির বয়স চলে যায়, মেয়েদের বিয়ের বয়স পার হয়ে যায়। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের সর্বত্র দুর্নীতির আখড়া বসেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে সংগঠিত সমস্ত অপকর্মের জন্য দায়ী ডোরাকাটা দল। ওই দলটি কতিপয় দেশদ্রোহী শিক্ষকদের একটি সংগঠন। তারা ছলেবলে কৌশলে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ক্ষমতা আপন মুঠোয় নিয়ে এই সুপ্রাচীন বিদ্যাপীঠটি ধ্বংস করার ষড়যন্ত্রে সর্বক্ষণ তৎপর রয়েছে। ডোরাকাটা দল এমন এক ব্যক্তিকে উপাচার্যের পবিত্র আসনটিতে বসিয়েছে, জ্ঞান বিদ্যার প্রতি যার বিন্দুমাত্র শ্রদ্ধাবোধও নেই। ওই উপাচার্যটি তার পোষা গরুর পেছনে যত সময় ব্যয় করেন, গোটা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য তার তিনভাগের এক ভাগ সময়ও ব্যয় করেন না। এই ব্যক্তি এই ঐতিহ্যমণ্ডিত বিশ্ববিদ্যালয়টিকে গোশালায় পরিণত করার বন্দোবস্ত একরকম পাকা করে এনেছেন। এই ব্যক্তি যদি দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকেন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণ সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস হয়ে যাবে, শুধু কঙ্কালটিই টিকে থাকবে। এখনো সময় চলে যায়নি। সকলের কাছে উদাত্ত আহ্বান রাখছি আমাদের এই মহান বিশ্ববিদ্যালয়কে ডোরাকাটা দল এবং তাদের মনোনীত উপাচার্য আবু জুনায়েদের চক্রান্ত থেকে রক্ষা করার জন্য সকলে এগিয়ে আসুন।