এই আড্ডাটি জমে উঠতে দেখে তিনি হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন । মনে মনে ভাবলেন, তিনি যে মাঝে-মাঝে শুক্রবার মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়েন, আল্লাহতায়ালা তার কিছু ফল দিতে আরম্ভ করেছেন। নইলে বলা নেই, কওয়া নেই, বলতে গেলে একেবারে শূন্য থেকে এই আচ্ছাটি জমে উঠত না। মাওলানা আবু তাহের শুভ সূচনাটি করে দিয়েছেন, একথা সত্য বটে। কিন্তু আল্লাহ তো তার রহমত কোনো ব্যক্তির অছিলায় বখশিস করে থাকেন।
আবু জুনায়েদের গোয়ালঘরের আড্ডায় যে সমস্ত শিক্ষক আসতে শুরু করেছেন, তাদের সম্পর্কেও কিছু না বললে অন্যায় করা হবে। মাওলানা আবু তাহের নিছক খেয়ালের বশে মিনি চিড়িয়াখানার ভিত গড়ে দিয়েছিলেন। তারপরে জনার্দন চক্রবর্তী চক্ষুকর্ণের বিবাদ ভঞ্জন করার জন্য এসেছিলেন। তারপরে এসেছিলেন পালি বিভাগের ড. সুমঙ্গল বড়ুয়া। বড়য়া বাবু তার জন্য একটি বাড়ি বরাদ্দের তদবির করতে এসেছিলেন। আবু জুনায়েদ এমনভাবে তার সঙ্গে কথা বলেছেন, তিনি বাড়ি পেতেও পারেন, আবার নাও পেতে পারেন। পেতে পারেন কারণ তার চাকরি অনেক দিনের। আবার না পেতে পারেন কারণ বাড়ি খুব অল্প, দাবিদার অনেক। যা হোক তিনি চেষ্টা করবেন। তারপর থেকে সুমঙ্গল বাবু আড্ডায় স্থায়ী সদস্য হয়ে গেলেন। তিনি আবু জুনায়েদের গরু এবং পাখিগুলোকেও পছন্দ করে ফেললেন। ড. সুমঙ্গল বড়য়ার পর ফিজিক্স বিভাগের ড. দেলোয়ার হোসেন। ড. দেলোয়ার হোসেনের ইন্টারমিডিয়েটে থার্ড ডিভিশন ছিল। সেটাই তার প্রফেসর হওয়ার পথে মস্ত বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভূরি ভূরি থার্ড ডিভিশন পাওয়া শিক্ষক প্রফেসর হয়ে গেছেন। সেটা আসল কথা নয়, বিভাগীয় চেয়ারম্যানের সঙ্গে ড. হোসেনের সম্পর্ক ভালো নয়। বিভাগীয় চেয়ারম্যান অনুমোদন করছেন না বলেই তার প্রমোশন ঠেকে আছে। উপাচার্য সাহেবকে গোয়ালঘরে নিরিবিলিতে পাওয়া যায়। তার উপর যে দীর্ঘকাল ধরে অবিচার চলছে সেই দুঃখের কথাটি জানাতে এসেছিলেন। আবু জুনায়েদ জানিয়েছিলেন ফিজিক্স বিভাগের চেয়ারম্যান খুব ঘাউরা টাইপের মানুষ। তবু তিনি তার প্রভাব খাঁটিয়ে চেষ্টা করবেন, কিছু করা যায় কি না। তারপর থেকে সন্ধ্যে হলেই ড. দেলোয়ার হোসেন আড্ডায় হাজির থাকতে আরম্ভ করলেন। এভাবে তিন মাসের মধ্যে অর্থী প্রার্থী মিলে বিশ পঁচিশ জন শিক্ষক গোয়ালঘরে নিয়মিত হাজিরা দিতে আরম্ভ করলেন। দর্শন বিভাগের আয়েশা খানম আসতে আরম্ভ করায় আড্ডাটির কিঞ্চিৎ জৌলুশ বেড়েছে। আয়েশা খানমের তেমন কোনো দাবি নেই। তবে তিনি পুরুষ মানুষের উপর প্রভাব বিস্তার করে যৌন সুখের মতো এক প্রকার সুখ অনুভব করে থাকেন। এই মহিলাকে সকলে কেন এড়িয়ে চলতেন, এক কথায় বলা মুশকিল। হয়তো তার বয়স একটু বেশি, হয়তো তার স্কুল বপু এবং পানদোক্তা খাওয়া গ্যাটগেটে লাল দাঁতের কারণে পুরুষ শিক্ষকেরা তাকে পছন্দ করেন না। মাছ যেমন পানিতে সাঁতার কাটে, পাখি আকাশে ওড়ে আয়েশা খানমও এই আড্ডার মূল কুশীলবদের একজন হয়ে গেলেন। তিনি সদস্যের জন্য বাড়ি থেকে কখনো চিড়ে ভাজা এবং কোরানো নারকেল এনে সকলকে খেতে দিতেন। মাঝে-মাঝে আবু জুনায়েদকেও কিছু গাঁটের পয়সা উপুড় করতে হতো। আড্ডার সদস্যদের নিয়মিত চা এবং বিস্কুট সরবরাহ করতে হতো। নিরামিষ আড্ডা স্থায়ী হয় না। একবার তিনি সেরা দোকান থেকে তন্দুরি এবং শিক কাবাব এনে সকলকে খাইয়েছেন। আরেকবার নাতি অন্তুর জন্মদিনে সকলকে সন্দেশ পায়েশ এবং শবরি কলা দিয়ে আপ্যায়ন করেছেন।
আবু জুনায়েদ লক্ষ্য করেছেন, তার এখানে যারা আসেন তারা কেউ বিশ্ববিদ্যালয়ের বেগুনি, হলুদ এবং ডোরাকাটা দলের সঙ্গে যুক্ত নন। সকলেই আলাদা আলাদা ব্যক্তি। কারো দলীয় পরিচয় নেই। ক্ষমতার সঙ্গে যুক্ত থাকাই নির্দলীয় শিক্ষকদের সবচাইতে বড় দল। আবু জুনায়েদ ভাবনাচিন্তা করতে আরম্ভ করেছেন, এই ভাঙাচোরা শিক্ষকদের সংগঠিত করেই তিনি ইচ্ছে করলে একেবারে নিজস্ব একটি দল খাড়া করতে পারেন। তার নিজের ডোরাকাটা দলটির কোনো কোনো শিক্ষক তাকে এমনভাবে নাজেহাল করতে আরম্ভ করেছেন, আত্মরক্ষার্থে এরকম কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন কি না, একথাটা তার বিবেচনার মধ্যে রয়েছে।
আবু জুনায়েদের চুটিয়ে আড্ডা দেয়ার একটা অসুবিধা হলো, টেলিফোন এলে তাকে বারে বারে ছুটে গিয়ে কল রিসিভ করতে হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যকে তো সরকারি বেসরকারি নানা ব্যক্তি এবং প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে যেতে হয়। বার বার উঠে যেতে হয় বলেই গল্পগুজবের মাঝখানে ছেদ পড়ে যায়। এক সন্ধ্যেবেলা জনার্দন চক্রবর্তী একটা অভিনব প্রস্তাব করে বসলেন :
-বৎস আবু জুনায়েদ তোমাকে টেলিফোনে কথা কহিবার জন্য বারে বারে উঠিয়া যাইতে হয়, ইহা আমাদের দৃষ্টিতে অত্যন্ত অশোভন বলিয়া প্রতীয়মান হয়। উপাচার্য কেন বার বার টেলিফোন যন্ত্রের কাছে ছুটিয়া যাইবে। ইহার অন্যরকম একটা বিহিত বাহির করিতে চেষ্টা করো।
আবু জুনায়েদ বললেন,
-স্যার কী করতে বলেন, তাহলে টেলিফোন কি রিসিভ করব না?
-বৎস আবু জুনায়েদ আমার কথার মর্ম তুমি অনুধাবন করিতে পার নাই। তুমি টেলিফোনের কাছে যাইবে কেন, টেলিফোন যন্ত্র তোমার কাছে ছুটিয়া আসিবে।