আবু জুনায়েদ জনার্দন চক্রবর্তীর কথায় খুব তুষ্ট হলেন। বললেন, আশীর্বাদ করবেন স্যার।
-বৎস আমার আশীর্বাদ নিরন্তর তোমাকে ঘিরিয়া রহিয়াছে। আমার আশীর্বাদের গুণে তুমি উপাচার্যের আসনে বসিয়াছ। এখন আশীর্বাদ করিতেছি তুমি রাষ্ট্রদূত হও। মন্ত্রী হও। ভগবান তোমাকে রাষ্ট্রপতির আসনে উপবেশন করাইবেন। মনে রাখিবে, আমি খাঁটি ব্রাহ্মণ, ব্রাহ্মণের আশীর্বাদ কদাচ মিথ্যা হইবার নয়।
.
১২.
আবু জুনায়েদের গোয়ালঘরের উত্তরের শেডে সান্ধ্য আচ্ছাটি চালু হয়ে গেল। যে সকল শিক্ষক বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাবে যেতে অপছন্দ করেন গাছের গুঁড়ির আড্ডায়ও যেতে পারেন না, এই নতুন আসরটি চালু হওয়ায় অনেকেই হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন। বিশ্ববিদ্যালয় ক্লাব একটি বাজার। সেখানে তাস চলছে, দাবা চলছে, টেনিস, ব্যাডমিন্টন এমনকি রাতের বেলা জুয়া পর্যন্ত চলছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের দলাদলির প্রধান আখড়া হলো এই ক্লাব। সর্বক্ষণ সভা হচ্ছে, গুজ-গুজ ফুসফুস চলছে। কে কাকে ল্যাং মেরে এগিয়ে গেল। কে সরকারের চামচাগিরি করতে গেল, কে আধারাতে বউকে ধরে পেটায়, কাজের বেটির সঙ্গে কে লটরটর কাণ্ড করেছে এই সকল মুখরোচক সংবাদ ক্লাবের হাওয়ায় ভেসে ভেসে বেড়ায়। যে সকল শিক্ষক নিজেদের অস্তিত্ব প্রমাণ করতে পারে না, ক্লাবের এই পাঁচমিশালি আড্ডায় বড় বেচারা বেচারা অনুভব করেন।
ক্লাব ছাড়া শিক্ষকদের আরো একটি আড্ডা আছে। আবাসিক এলাকার ভেতরে ড. আহমদ তকির বাড়ির সামনে একটা গাছের গুঁড়ির উপর সন্ধ্যেবেলা এই আচ্ছাটি বসে। ঝড় বৃষ্টি হলে লোকজন ড. আহমদ তকির ড্রয়িং রুমে এসে আশ্রয় নেন। একবার ঝড়ের সময় প্রকাণ্ড একটি শিশু গাছ কাণ্ডসুদ্ধ উপরে উঠে এসে ভূপাতিত হয়েছিল। ডালপালা সব ছেটে ফেলে সরানো হয়েছে, কিন্তু ড. আহমদ তকি এবং তার মতো আরো কতিপয় প্রবীণ শিক্ষক এই গুঁড়িটি সরাতে দেননি। তারপর থেকেই গুঁড়িটি সান্ধ্য আড্ডার স্থান হিসেবে এন্তার কুখ্যাতি অর্জন করেছে। কী কারণে এই গুঁড়ির আড্ডাটির দুর্নাম একটু বুঝিয়ে বলার অপেক্ষা রাখে। ড. আহমদ তকি ঘোষণা করেছেন তিনি নাস্তিক। আল্লাহ রসুলের ধার তার না পারলেও চলে। কোরান-হাদিসে তার বিশ্বাস নেই। এই আড্ডায় মাঝে-মাঝে নাস্তিকতা বিষয়ক আলাপ-সালাপ হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু কিছু সিনিয়র শিক্ষক, এমনকি তরুণদের মধ্যেও কেউ কেউ নিজেরা সরাসরি নাস্তিক না হয়েও ড. আহমদ তকিকে পছন্দ করে থাকেন। কারণ ড. আহমদ তকি একদিকে যেমন গোঁয়ার, তেমনি আবার রসিকও বটে। এ ধরনের মানুষ যিনি নিজের বিজ্ঞতা বা অজ্ঞতা চিৎকার করে প্রকাশ করতে পারেন তার কিছু চেলা জুটে যাবে, এটা তো খুবই স্বাভাবিক। ড. আহমদ তকিই হলেন গাছের গুঁড়ির আড্ডার প্রধান ব্যক্তি। অন্যদের ভূমিকা নিতান্তই গৌণ। সাম্প্রতিককালে প্রবীণ শিক্ষকদের অনেকেই এই গাছের গুঁড়ির আড্ডায় আসতে আরম্ভ করেছেন। ড. আহমদ তকির ব্যক্তিত্বের আকর্ষণ তার একমাত্র কারণ নয়। ড. আহমদ তকি ভদ্রলোকটি একাধারে নাস্তিক এবং আবু জুনায়েদ বিরোধী। কোনোরকম রাখঢাক না করেই উপাচার্য আবু জুনায়েদকে তিনি ছাগল, বলদ, গাধা ইত্যাকার নামে সম্বোধন করে থাকেন। প্রবীণ শিক্ষকদের অনেকেরই আবু জুনায়েদের প্রতি জন্মগত বিতৃষ্ণা রয়েছে। তাদের মতো উপযুক্ত ব্যক্তিত্ব থাকতে আবু জুনায়েদের মতো একজন ওঁচা মার্কা মানুষ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের আসনে বসল এই ঘটনাটি কি আবু জুনায়েদের প্রতি বিদ্বিষ্ট হওয়ার মুখ্য কারণ হতে পারে না? কিছুদিন থেকে কয়েকদিন অন্তর অন্তর সুন্দরী দিলরুবা খানম এই আড্ডায় অংশগ্রহণ করতে আরম্ভ করেছেন। যদিও প্রবীণ শিক্ষকদের স্ত্রীরা দিলরুবা খানমকে ভীষণ অপছন্দ করেন, কিছুটা ঝুঁকি নিয়ে হলেও তারা দিলরুবার সঙ্গে মেলামেশা করেন। দিলরুবা যখন আসেন তার পিঠ ঝাপা এলানো চুলের সৌরভে বাতাস পর্যন্ত গন্ধময় হয়ে ওঠে। কাঠ কয়লায় আগুনের ছোঁয়া লাগলে যেমন নতুন করে আগুন জ্বলে ওঠে, তেমনি দিলরুবা খানম এলেই বুড়ো অধ্যাপকেরা রক্তের মধ্যে যৌবনের তেজ অনুভব করতে থাকেন। দিলরুবা ঝড়ের মতো আসেন, ঝড়ের মতো চলে যান। এই গতিময়তাই তাকে অনেক বেশি আকর্ষণীয় করে তুলেছে। তিনি এসেই আবু জুনায়েদের কুকীর্তির কথা পাঁচ কাহন করে বলতে থাকেন। তার মধ্যে সত্যের ভাগ যথেষ্ট নয়, তথাপি তার বলার ভঙ্গিটি এমন মনোরম যে সকলকে তার মতে সায় দিতে হয়। আবু জুনায়েদকে দেখলে মানুষের শরীরে বোয়াল মাছের মাথা লাগানো এক কিম্ভুতকিমাকার প্রাণীর মতো মনে হয়, এই আশ্চর্য সাদৃশ্যটি তিনি এই আড্ডায় এসে আবিষ্কার করেছিলেন।
বিশ্ববিদ্যালয় ক্লাবে যারা যান না, গাছের গুঁড়ির নাস্তিকদের আড্ডায় যেতে ঘৃণাবোধ করেন, সেই সমস্ত শিক্ষকেরা আবু জুনায়দের গোয়ালঘরে সন্ধ্যেবেলা আসতে আরম্ভ করেছেন। আবু জুনায়েদ ভেবে দেখলেন এবারেও বিনা প্রয়াসে ভাগ্য তাকে অনুগ্রহ করেছে। তিনি ভীতি এবং আতঙ্কের মধ্যে দিন কাটচ্ছিলেন। মানসিক নিঃসঙ্গতাবোধ তাকে ভয়ানক রকম পীড়ন করছিল। বাড়িতে নুরুন্নাহার বানুর সঙ্গে কোনো সম্পর্ক নেই। ঝগড়ার সম্পর্কও একটি সম্পর্ক আবু জুনায়েদ গভীরভাবে উপলব্ধি করলেন। তার প্রবল শঙ্কা শেখ তবারক আলীর দেয়া গরু এবং গোয়াল বিষয়ক ঘটনাগুলো প্রকাশিত যদি হয়ে পড়ে তিনি সমাজে সর্বকালের সবচাইতে দুর্নীতিপরায়ণ উপাচার্য হিসেবে নিন্দিত হবেন। আত্মহত্যা করেও তিনি কলঙ্কের দায় থেকে মুক্ত হতে পারবেন না।