মাওলানা বললেন, সব কাণ্ড এখনো শেষ হয়নি, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আপনি দেখুন, এখনো কিছু কাণ্ড বাকি আছে।
মাওলানা আবু তাহের পেরেক, হাতুড়ি এসব নিয়ে একেবারে তৈরি হয়ে এসেছিলেন। তারপর অনেকক্ষণ ধরে ঠুকে ঠুকে দেয়ালে পেরেক বসিয়ে খাঁচাগুলো ঝুলিয়ে দিলেন । শালিক, চন্দনা, টিয়া, ময়না, দোয়েল, বুলবুল যে সকল পাখির নাম মাওলানা বলেছিলেন সব প্রজাতির পাখি জোড়ায় জোড়ায় খাঁচাতে ভরে এনেছেন। নতুন জায়গায় আসার কারণে, একসঙ্গে সবগুলো পাখি ডেকে উঠল । পাখিদের কলকাকলিতে আচমকা নির্জন গোয়াল ঘর মুখরিত হয়ে উঠল। অন্তু হাত তালি দিয়ে চিৎকার করে উঠল, ও নানু পাখি, অ-নে-ক পাখি।
আবু জুনায়েদ বললেন, হ্যাঁ নানু অনেক পাখি। জনার্দন চক্রবর্তী হলেন আবু জুনায়েদের মিনি চিড়িয়াখানার প্রথম দর্শক। তার বিষয়ে কিঞ্চিৎ ভূমিকা দেয়া প্রয়োজন। তিনি সংস্কৃতের প্রবীণ শিক্ষক। চাকরির মেয়াদ অনেকদিন আগেই ফুরিয়েছে। যেহেতু সংস্কৃত ব্যাকরণ এবং অলঙ্কারশাস্ত্রের শিক্ষক পাওয়া দুরূহ হয়ে উঠেছে, তাই দুবছর একসূটেনশন দিয়ে জনার্দন চক্রবর্তীর চাকরি এত দিন পর্যন্ত বহাল রাখা হয়েছে। সাম্প্রতিককালে বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয় থেকে একজন তরুণ দুলাল বিশ্বাস ব্যাকরণ এবং অলঙ্কারশাস্ত্রে ডক্টরেট করে এসেছেন। এবার জনার্দন চক্রবর্তীর চাকরি নবায়নের কোনো সম্ভাবনা ছিল না। কিন্তু জুনায়েদ নিজে থেকে উদ্যোগ নিয়ে জনার্দন চক্রবর্তীর চাকরি নবায়ন করেছেন। এ নিয়ে অনেক কথা হয়েছে। আবু জুনায়েদ সেসব আমলে আনেননি । জনার্দন চক্রবর্তীর প্রতি এই পক্ষপাতের একটা কারণ অবশ্য আছে। জনার্দন চক্রবর্তীর বাড়ি আবু জুনায়েদের এদিকে । আবু জুনায়েদ যে স্কুলের ছাত্র সেখানে তিনি সংস্কৃত এবং বাংলা পড়াতেন। স্কুলে থাকার সময়ে তিনি টোল থেকে আদ্য মধ্য এবং উপাধি পাস করেছিলেন। একবার তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক বাঘা সংস্কৃত অধ্যাপকের অন্বয় নির্ধারণে ভুল ধরিয়ে দিয়েছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ভদ্রলোক তাকে টুলো পণ্ডিত বলে অবজ্ঞা করেছিলেন। ঘা খেয়ে তিনি প্রাণপণ প্রতিজ্ঞা করেছিলেন যে সংস্কৃতে তিনি এম, এ পাস করে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করবেন। জনার্দন চক্রবর্তী সে জেদ প্রমাণ করে ছেড়েছেন। জনার্দন চক্রবর্তীর বয়স এখন সত্তর পেরিয়ে গেছে। এখনো বেশ শক্তসমর্থ আছেন। কেবল সামনের চোয়ালের দাঁত কটি পড়েছে। বাড়িতে এখনো কাষ্ঠপাদুকা ব্যবহার করেন এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে আসার সময়ে বিদ্যাসাগরী চটি পরে চটাং চটাং শব্দ করে ক্লাস নিতে আসেন।
জনার্দন চক্রবর্তী এখনো আবু জুনায়েদকে তুমি সম্বোধন করেন। ছোট ছোট ব্যাপারে আবু জুনায়েদকে বকাবকি করতেও ছাড়েন না। তিনি মনে করেন, এখনো তার সে অধিকার আছে। জনার্দন বাবু যখন রেগে যান, পাঞ্জাবির বুকে হাত দিয়ে শুভ্র উপবীতটি টেনে বের করে বলেন, আমি খাঁটি ব্রাহ্মণ, উপবীত স্পর্শ করে যদি শাপ দেই লেগে যাবে। ভয় অনেককেই দেখিয়েছেন, কিন্তু শাপ কাউকে দিয়েছেন কেউ বলতে পারবে না। কথা বলার সময় তৎসম শব্দ ব্যবহার করার দিকে ঝোঁকটা বেশি। অবশ্য ঘরে তিনি তার জেলার উপভাষাটি ব্যবহার করে থাকেন। সাধু ভাষায় কথা বলতে পারলে তিনি স্বস্তি অনুভব করেন। এক সন্ধ্যেবেলা তিনি হেলতে দুলতে আবু জুনায়েদের মিনি চিড়িয়াখানায় এসে হাজির। আবু জুনায়েদ তখনো নিজের হাতে টুকরো টুকরো নেপিয়র ঘাস গরুকে খাওয়াচ্ছিলেন। জনার্দন চক্রবর্তী এসে হাঁক দিলেন,
-বৎস বিশ্বস্ত সূত্রে আমি অবগত হইলাম তুমি রামায়ণে বর্ণিত সুবর্ণ মৃগের মতো একটি রূপ যৌবনসম্পন্ন স্ত্রী জাতীয় গরুরত্ন সংগ্রহ করিয়াছ। কথাটি শ্রবণ করিবার পরেও আমার মনে প্রত্যয় হয় নাই। ভাবিলাম চক্ষু কর্ণের বিবাদ ভঞ্জন করিয়া আসি।
আবু জুনায়েদের কিছু বলার পূর্বেই পাখির খাঁচাগুলোর দিকে জনার্দন বাবুর চোখ পড়ল। তিনি বলে বসলেন, সাধু সাধু বৎস আবু জুনায়েদ আমি আপন অক্ষি গোলকে প্রত্যক্ষ করিলাম, তুমি অনেকগুলি বিহঙ্গকেও প্রশ্রয় দিয়াছ। আমি জানিতাম তোমার অন্তঃকরণ জীবের প্রতি প্রেমে পরিপূর্ণ। সংসারে যাহারা প্রকৃত মানুষ, তাহারা জীবের মধ্যে শিবের অস্তিত্ব প্রত্যক্ষ করেন। সেই দিক দিয়া বিচার করিলে তোমার স্থান অত্যন্ত উঁচু হওয়া উচিত। তুমি বিশ্ববিদ্যালয়ে একটা অভিনব দৃষ্টান্ত স্থাপন করিলে। তা তোমার গাভীটি কোথায়?
জনার্দন বাবুর দৃষ্টিশক্তি হালে ক্ষীণ হয়ে পড়েছে। তিনি ঠিকমতো ঠাহর করতে পারছিলেন না। আবু জুনায়েদ তাকে একেবারে হাত ধরে গোয়াল ঘরের একান্ত সন্নিকটে গিয়ে বাতিটি জ্বালালেন। তারপর মশারি উন্মোচন করে বললেন,
-এই যে স্যার দেখুন।
জনার্দন চক্রবর্তী কিছুক্ষণ কথা বলতে পারলেন না। তিনি সামনে পেছনে গিয়ে গরুটাকে বেশ ভালো করে খুটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলেন। গায়ে হাত দিয়ে পরীক্ষা করলেন। গরুটি ঘাড় উঠিয়ে জনার্দন চক্রবর্তীর মাথা চাটতে ছুটে এল। তিনি দুপা পিছু হটে এসে বলতে থাকলেন,
-বৎস আবু জুনায়েদ তোমাকে একটা মনের কথা বলিব।
আবু জুনায়েদ বললেন, বলুন স্যার।
-শোন বৎস আমাদের শাস্ত্রে গাভীকে মাতার সঙ্গে তুলনা করা হইয়াছে। যে পাষণ্ড গাভীর মধ্যে মাতৃমূর্তি দর্শন করিতে না পারে, তাহাকে জন্ম জন্মান্তর তীর্যক যোনিতে জন্মগ্রহণ করিতে হইবে। এই হইল গিয়া তোমার শাস্ত্রের বিধান। তথাপি তোমার এই চতুষ্পদের কন্যাটিকে দেখিয়া আমার মনে ভিন্ন ধরনের জল্পনা শুরু হইয়াছে। সংস্কৃত কাব্যে এক ধরনের সুন্দরী রমণীকে হস্তিনী রমণী বলিয়া মহাকবিগণ শনাক্ত করিয়া গিয়াছেন। তোমার গাভী দর্শন করিয়া আমার কী কারণে হস্তিনী নায়িকার কথা মনে হইতেছে বলিতে পারি না। মহাকাব্যের যুগে যেই ধরনের গাভীকে কামধেনু বলা হইত তোমার গাভীটি সেই জাতের। ইহাকে যত্ন করিয়া রাখিবে।