আবু জুনায়েদ বললেন,
-মাওলানা সাহেব গরুর ভাগ্য আর আপনার এলেমের তেজ।
মাওলানা আবু তাহের দাঁতে জিভ কাটলেন,
-ভাই ওই রকম কথা বলবেন না। আল্লাহ আপনাকেই এলমে লাদুন্নি বখশিস করেছেন। এই এলমে লাদুন্নি ছিল বলেই আপনি এত উপরে উঠতে পেরেছেন । আমি অতিশয় এক নাদান বান্দা। আমি তাই আপনাকে বিশেষ একটা অনুরোধ করব। যদি আপনি রাখেন।
আবু জুনায়েদ বললেন,
–বলুন আপনার অনুরোধ কী
মাওলানা সাহেব জবাব দিলেন,
-আমি আপনাকে স্বার্থপরের মতো আচরণ না করতে বলব ।
আবু জুনায়েদ বললেন,
-আমি স্বার্থপরের মতো আচরণ কোথায় করলাম। আপনিও এ কথা বলেন?
-আমি না বললে কে বলবে আপনি এ বাড়ির পেছনে এমন এক সুন্দর পরিবেশ সৃষ্টি করেছেন প্রথমত সে কথা জানাননি। দ্বিতীয়ত একা একা এই জান্নাতের শান্তি উপভোগ করছেন, বন্ধু-বান্ধবকে তার হিস্যা দিচ্ছেন না।
আবু জুনায়েদ একটু অবাক হয়ে বললেন,
-মাওলানা আপনি আমাকে কী বলতে চাইছেন বুঝতে পারছি না। যা হোক, বলুন আমাকে কী করতে হবে।
মাওলানা আবু তাহের উচ্চহাস্য করে উঠলেন এবং তারপর বললেন,
-এইখানে আপনি চমকার বসার বন্দোবস্ত করেছেন। সন্ধ্যেবেলা বন্ধু বান্ধবদেরও বসার বন্দোবস্ত করে দিন। চমৎকার এক জায়গা। চারদিকে গাছ গাছালিতে ঢাকা। এখানে বসে একটু প্রাণ খুলে কথাবার্তা বলা যাবে। আমাদের এলাকায় শান্তিতে নিরিবিলিতে কোথাও বসার জায়গা নেই। যেখানেই যান দেখবেন, মানুষ মানুষকে নলদাত মেলে কামড়াতে আসছে।
মাওলানা আবু তাহেরের প্রস্তাবটা আবু জুনায়েদের মনে ধরল। এই গরুটাকে সকলের সঙ্গে শেয়ার করার ইচ্ছে তার ছিল। কিন্তু তবারক সাহেবের হুঁশিয়ারিতে তিনি দমে গিয়েছিলেন। মাওলানা আবু তাহের যখন নিজে থেকেই প্রস্তাবটা করলেন আবু জুনায়েদ হাতে চাঁদ পেয়ে গেলেন। মাওলানার প্রস্তাবে সায় দিয়ে বললেন,
-তা মাওলানা আপনারা এসে বসুন, গল্পগুজব করুন । আপনাদের বারণ করেছে কে?
-ভাই আপনি এরকম বলবেন আমি জানতাম। আমরা অবশ্যই আসব । একটা বসার জায়গা হলো, আসব না, সে কেমন কথা। কিন্তু আপনাকে তার জন্য আরো কিছু খরচ করতে হবে। এমনিতে আপনার রুচির তারিফ না করে পারিনে। গোয়ালটা বানিয়েছেন চমৎকার। মাশাল্লাহ গরুটিও হয়েছে খুব খুবসুরত । আপনি আরো কিছু পশুপাখি কিনুন। যেমন ধরুন ময়না, টিয়ে, দোয়েল, বুলবুলি আর শালিক। যদি সম্ভব হয় এক দুটি ভালো জাতের কুকুরও রাখবেন।
আবু জুনায়েদ বললেন,
-মাওলানা কুকুর আমার দুচোখের বিষ । এই জিনিস আমাকে রাখতে বলবেন না।
-ভাই আপনি ক্ষেপে যাচ্ছেন কেন? আপনি জানেন না একটা কুকুর বেহেশতে যাবে। আসহাবে কাহাফের সঙ্গে যে কুকুরটি ছিল, সে সরাসরি পুলসিরাতের উপর দিয়ে হেঁটে বেহেশতে চলে যাবে। মাওলানা গালিবের একটা উর্দু কবিতাংশ পাঠ করে শোনালেন, মানুষ যদি কুকুরের কাছ থেকে কৃতজ্ঞতা শিক্ষা করতে পারত এতদিনে দুনিয়া জান্নাত হয়ে যেত।
আবু জুনায়েদকে গলানো গেল না। বরং তিনি মাওলানা তাহেরকে উল্টো দিক থেকে চেপে ধরলেন।
-মাওলানা আপনার এত কুকুর প্রীতি কেন? বুড়ো বয়সে কি গায়ে সাহেবদের হাওয়া লাগল?
মাওলানা তাহের বললেন, আচ্ছা কুকুরের দাবি উঠিয়ে নিলাম। ঘুঘু, শালিক, টিয়া, ময়না, চন্দনা, দোয়েল, বুলবুল এসব রাখুন। একটা ছোটখাট চিড়িয়াখানা হয়ে যাবে। আপনার এই মিনি চিড়িয়াখানা এক সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থায়ী সম্পদে পরিণত হবে।
আবু জুনায়েদের প্রস্তাবটা ভীষণ মনে ধরেছে। তবু তিনি আমতা-আমতা করে বললেন,
-অনেক খরচাপাতির ব্যাপার, দেখার লোক কই। তাছাড়া নানা রকম কথা উঠতে পারে ।
মাওলানা তাহের ফোড়ন কেটে বললেন,
-জুনায়েদ সাহেব আপনি হাসালেন। হাতি খরিদ করার পর বলছেন রশির কিবা দাম। আপনার গোয়াল ঘর বানাতে কত খরচ পড়েছে। এই বুররাক মার্কা গরু কিনতে গেছে কত টাকা। এই চিড়িয়া সবগুলো কিনতে পাঁচ হাজার টাকার বেশি খরচ পড়বে না। বিশ্ববিদ্যালয়ের তহবিল থেকে এই টাকা খরচ করার অধিকার নিশ্চয়ই উপাচার্যের আছে। থাক টাকার বিষয় নিয়ে আপনাকে চিন্তা করতে হবে না। এই গরিব বান্দা খাতা দেখার টাকা থেকে এই চিড়িয়াগুলো কিনে দেবে।
আবু জুনায়েদ বললেন, কিন্তু দেখাশোনা করবে কে? মাওলানা বললেন, কেন গরু যে দেখাশোনা করে তার উপর চিড়িয়ার দায়িত্ব ছেড়ে দেবেন। বেটা তো কেবল খায় আর ঘুমোয়? সপ্তাহ গত হতেই মাওলানা আবু তাহের একটি পায়ে টানা ভ্যানের উপর দশ বারটি খাঁচা চাপিয়ে একেবারে সরাসরি উপাচার্য ভবনের কম্পাউন্ডে এসে হাজির হলেন। তিনি দারোয়ান এবং বেয়ারার সাহায্যে খাঁচাগুলি নামিয়ে একেবারে গোয়ালঘরে নিয়ে এলেন। আবু জুনায়েদ উত্তরের শেডে বসে নাতি অন্তুর সঙ্গে হাম্বা হাম্বা খেলা করছিলেন। অন্তু আবু জুনায়েদকে বলছে, নানু হাম্বা বলো। নাতিকে খুশি করার জন্য আবু জুনায়েদ বললেন, হাম্বা। অন্তু অত অনুচ্চ ডাকে খুশি হওয়ার ছেলে নয়। তার পাঞ্জাবির কোণা আকর্ষণ করে বলল, নানু আরো জোরে বলো, হাম্বা ।
আরো জোরে হাম্বা বলতে গিয়ে আবু জুনায়েদ দেখতে পেলেন তার মুখোমুখি মাওলানা আবু তাহের দাঁড়িয়ে আছেন। দারোয়ান এবং বেয়ারা মিলে একটা দুটো করে সবগুলো খাঁচা উত্তরের শেডে এনে রাখল। দেখে আবু জুনায়েদের চক্ষু চড়কগাছ। অস্ফুটে উচ্চারণ করে বসলেন, মাওলানা এ কী কাণ্ড করলেন।