রেবা আসার পর পরিবারে একটা শৃঙ্খলা ফিরে এসেছে। আবু জুনায়েদ এবং নুরুন্নাহার বানুর মধ্যে, নুরুন্নাহার বানু এবং দীলুর মধ্যে যে একটা সংঘাত আসন্ন হয়ে উঠেছিল তার বিস্ফোরণোন্মুখ হয়ে ওঠার ক্ষমতা অনেক পরিমাণে হাস পেয়েছে। নুরুন্নাহার বানু তার নাতি, কন্যা এবং জামাতাকে নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। আবু জুনায়েদ যা ইচ্ছে করুন, তার কথা না ভাবলেও তার চলে। আবু জুনায়েদ তার কাজকর্ম নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। তার মধ্যে এক ধরনের নির্লিপ্ততাবোধ জন্ম। নিয়েছে। যা ঘটবার আপনিই ঘটবে। উপাচার্য থাকুন, আর নাই বা থাকুন, তিনি পরোয়া করেন না। মাঝে-মাঝে তিনি বিষয়টা নিয়ে এ রকম চিন্তা করেন, আমার তো উপাচার্য হওয়ার কথা ছিল না। উপাচার্যের চাকরি তার জীবনের মহত্তম দুর্ঘটনা। এই চাকরি যদি চলেই যায়, যাবে । লোকে কী ভাববে, কী মনে করবে এ নিয়ে আর বিশেষ তোয়াক্কা করেন না। তার নিজের মতো করে বেঁচে থাকার একটা পদ্ধতি তার মধ্যে ভেতর থেকে সংহত হয়ে উঠছে। গরুটার প্রতি তার পক্ষপাত কম্পাসের কাটার মতো হেলে রয়েছে। যদিও নুরুন্নাহার বানু গরুটাকে যাবতীয় অকল্যাণের হেতু বলে মনে করছেন এবং তার সঙ্গে এ নিয়ে তুলকালাম কাণ্ড করেছেন, তার মনোভাব অপরিবর্তিতই থেকে গেছে।
সকাল বেলা তিনি গরুর সঙ্গে কাটান। ঘুম থেকে উঠে আবু জুনায়েদ গোয়াল ঘরে যাবেনই । আজকাল শরীর বিশেষ ভালো যাচ্ছে না। তাই দুপুরের গরু সন্দর্শনে যাওয়া ঠিকমতো হয়ে ওঠে না। বিকেলবেলা অবশ্যই তিনি গোয়াল ঘরে যান। সভা-সমিতিতে যাওয়ার বিশেষ স্পৃহা তিনি বোধ করেন না। তার বক্তৃতার নিন্দে করার মানুষের অভাব নেই। সবদিক থেকে তিনি নিজেকে গুটিয়ে নিচ্ছেন। বিকেলের সমস্ত সময়টা তিনি নিজের জন্য রাখেন এবং গোয়াল ঘরে চলে আসেন। কোনো কোনোদিন নাতিটাকেও সঙ্গে সঙ্গে নিয়ে আসেন। গরুর প্রতি নাতিটারও একটা টান পড়ে গেছে। তিনি যদি কোনোদিন অন্তুকে রেখে আসেন, অন্তু চিৎকার করতে থাকে,
-নানু হাম্বা যাব, হাম্বা যাব ।
নুরুন্নাহার বানু এটা মোটেও পছন্দ করেন না। তার নজরে পড়লে তিনি অন্তুকে জোর করে কোলে উঠিয়ে অন্যদিকে নিয়ে যান। অল্প পা আছড়ে কাঁদতে থাকে।
আরবির শিক্ষক মাওলানা আবু তাহের মাসুম এক সময় আবু জুনায়েদের প্রতিবেশী ছিলেন। আবু জুনায়েদ আগে মাওলানা তাহেরের সঙ্গে প্রাতভ্রমণে বের হতেন। আবু জুনায়েদ উপাচার্য হওয়ার কারণে গোটা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাত্র একজন মানুষ যদি খুশি হয়ে থাকেন, তিনি মাওলানা আবু তাহের। মাওলানা তাহেরের সঙ্গে আবু জুনায়েদের একটা হাসি-ঠাট্টার সম্পর্ক ছিল। মাওলানা রসিক মানুষ। আজানুলম্বিত দাড়ি, লম্বা আচকান এবং কানপুরি টুপিতে ঢাকা মাওলানার শরীর । এই দাড়ি টুপি এবং আচকানের ভেতর থেকে এমন রসিকতা প্রকাশ পেত শুনলে অত্যন্ত গোমরা মানুষেরও পেটে খিল ধরে যেত। এখনো আবু জুনায়েদ যে মাঝে মাঝে নামাজের পাটিতে দাঁড়ান, মাওলানার প্রভাবে সেটা হয়েছে। মাওলানার সঙ্গে আবু জুনায়েদের বিশেষ আঁটাআঁটি নেই । উপাচার্য অফিসে হোক কি বাড়িতে হোক, মাওলানা আবু তাহের আবু জুনায়েদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে কারো তোয়াক্কা করেন না। সরাসরি চলে আসেন। এক সন্ধ্যেয় মাওলানা আবু জুনায়েদকে তার বাড়িতে এসে তালাশ করলেন। আবু জুনায়েদের বেয়ারা জানালে তিনি পেছনের গোয়াল ঘরে রয়েছেন। বাড়ির পেছনে আবু জুনায়েদ যে একটি গোয়াল ঘর তৈরি করেছেন, মাওলানা জানতেন না। গোয়াল ঘরের অবস্থান জেনে মাওলানা এসে দেখেন, আবু জুনায়েদ আপন হাতে টুকরো করে, কাটা নেপিয়র ঘাস অল্প অল্প করে গরুর মুখে তুলে দিচ্ছেন। তিনি বললেন,
-আসসালামু আলাইকুম জুনায়েদ সাহেব। মাসখানেক আপনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে আসতে পারিনি, গুস্তাকি মাফ করবেন।
আবু জুনায়েদ বললেন,
-আরে মাওলানা সাহেব আসেন, আসেন, কয়েকদিন থেকে আমি মনে মনে আপনাকেই খুঁজছিলাম। আবু জুনায়েদ নেপিয়র ঘাসের চুপড়িটা গরুর সামনে রেখে উত্তর দিকের শেডটার বাতি অন করলেন। ঝলমল করে আলো জ্বলে উঠতেই গরুটা মাওলানার নজরে পড়ে গেল। এক ঝলক দেখেই মাওলানার কণ্ঠ দিয়ে বিস্ময়সূচক একটি ধ্বনিই বেরোল :
-মাশাল্লাহ, এই সুন্দর জিনিস আপনি পেলেন কেমন করে? পিঠে দুইখানি পাখা থাকলে অনায়াসে বলা যেতে পারত এটা বুররাক।
আবু জুনায়েদ বললেন, আল্লাহ দেনেঅলা, তিনিই মিলিয়ে দিয়েছেন।
মাওলানা সাহেব কোরআনের একটা আয়াত আবৃত্তি করলেন, তার অর্থ দাঁড়াবে, আল্লাহ যাকে ইচ্ছে দান করেন, যাকে ইচ্ছে কেড়ে নেন। যাকে ইচ্ছে সম্মানিত করেন, যাকে ইচ্ছে লাঞ্ছিত করেন। তারপর দুহাতে আলগোছে দাড়ি মুঠি করে বললেন,
-আপনি সঠিক পথটি বেছে নিয়েছেন। বেবাক দেশ খবিশ এবং খান্নাসের আওলাদ, নাতিপুতিতে ভরে গেছে। এই জাতির মানুষের সঙ্গে মেলামেশা করার চাইতে হাইওয়ানের মহব্বত অনেক বেহেতর। আপনার গরুটি সম্পর্কে তাই একটি কথাই আমি বলব । আপনার গরুটির চেহারা সুরত যে রকম, কোরআন মজিদের সুরা বাকারায় এই রকম একটা গরুর কথা বলা হয়েছে। কেবল দুইটা তফাৎ। সুরা বাকারায় যে গরুটির কথা উল্লেখ আছে, সেটির গায়ের রঙ উজ্জ্বল হলুদ আর আপনার গরুটির রঙ লাল। আর আপনার গরুর চাকা চাকা দাগ আছে। সুরা বাকারার গরুতে তেমন কোনো দাগের কথা উল্লেখ নেই ।