রেবার বর ইকবাল ছেলেটিকে নুরুন্নাহার বানু খুবই পছন্দ করেন। তার এই বিপদের দিনে যেভাবে পাশে এসে দাঁড়িয়েছে, যেভাবে নীরবে মচকে যাওয়া সংসারটির শুশ্রূষা করে যাচ্ছে, দেখে নুরুন্নাহার বানু অভিভূত হয়ে গেছেন। নুরুন্নাহার বানুর কোনো ছেলে নেই। ছেলে না থাকলে নারীর মনে একটা হাহাকার থেকেই যায়। নুরুন্নাহার বানু ছেলেটাকে তাদের সঙ্গে একেবারে রেখে দেয়ার কথা চিন্তা করেন। কিন্তু ইকবালের বদলির চাকরি। তার থাকার উপায় নেই। নুরুন্নাহার বানু ভাবেন, ঢাকাতে যদি কোনো কাজকর্ম পাওয়া যেত ছেলেটাকে নিজের কাছে রেখে দিতে পারতেন। সরকারি চাকরি হতে হবে এমন কোনো কথা নেই। যে কোনো ধরনের একটা দ্ৰ চাকরি হলেই চলে যায়। আবু জুনায়েদ এত বড় একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান। প্রতিদিন তার হাত দিয়ে কত লোকের চাকরি হচ্ছে। অথচ এমন সোনার টুকরো জামাই, তাকে একটা চাকরি দেয়ার ক্ষমতা আবু জুনায়েদের নেই। শেখ তবারক আলীর কথা কেন জানি তার মনে উদয় হলো। আর সারা শরীর কেঁপে গেল, এখনো নুরুন্নাহার বানু শেখ তবারকের কাছ থেকে উপকার প্রত্যাশা করেন।
রেবার ছেলে অন্তু এই মনস্তাপপীড়িত বাড়িতে এক ঝলক ফাল্গুনের হাওয়া এনে দিয়েছে। তার বয়স সবে দুই পেরিয়েছে। বয়সের তুলনায় তার বাড় অনেক বেশি। এই দুরন্ত সর্বাঙ্গে প্রাণপূর্ণ শিশুটি ছোট ছোট পায়ে টলমল টলমল করে যখন হাঁটে দেখে মনে হয় তার চরণের ছন্দের মধ্যে সমস্ত পৃথিবীর প্রাণস্পন্দন ধ্বনিত হয়ে ওঠে। অন্তু যখন নব উথিত সাদা দাঁতগুলো দেখিয়ে হাসে দেখে মনে হয় জগতের যা কিছু সুন্দর, নিষ্পাপ এই শিশুটির শুভ্র হাসির মধ্য দিয়ে ফুলের মতো বিকশিত হয়ে উঠেছে। একদণ্ড বিশ্রাম নেই অন্তর । গাছে পাখি দেখলে আ আ করে ডাকে। আপনি নাচে আপনি হাসে, ঝরনার মতো শিশুকণ্ঠে কল কল করে কথা বলে যায়। এই নাতিটিকে দেখলে নুরুন্নাহার বানু সমস্ত দুঃখ, সমস্ত বেদনার কথা ভুলে যান। তাকে বুকে টেনে আদর করেন। অন্তু নানির কোল থেকে মার কোলে, মার কোল থেকে নানার কোলে, নানার কোল থেকে দীলুর কোলে ঝাঁপিয়ে পড়তে বড় বেশি ভালবাসে। সকালবেলা নাস্তা খাওয়ার পর ক্রমাগত কোল বদল করা অন্তর একটা চমৎকার খেলা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই বাড়ির পরস্পরের কাছ থেকে দূরে দূরে সরে যাওয়া মানুষদের মধ্যে অন্তু একটা নতুন যোগসূত্র রচনা করেছে।
অন্তর মুখে সবে কথা ফুটতে আরম্ভ করেছে। আবু জুনায়েদকে যখন নানা বলে তার কোলে ঝাঁপিয়ে পড়ে, শত ব্যস্ততার মধ্যেও অন্তুকে একটু আদর করে, তার শিশুমুখে চুমো খেয়ে একটা অনাবিল শান্তির পরশ খুঁজে পান। অল্প আবু জুনায়েদের ফাইল ধরে টানাটানি করে। গোছানো কাগজপত্র আউলা করে ফেলে। একটুও বিরক্ত হন না আবু জুনায়েদ। হাসিমুখে অন্তুর সমস্ত উৎপাত অত্যাচার সহ্য করেন। খালামনি বলতে এই শিশুটি পাগল । দীলুর কোলে একবার উঠলে আর নামতে চায় না। সে তার চুল ধরে টানে, কানের ফুল নিয়ে খেলা করে। দীলুর বেশ লাগে। দীলু কলেজে গেলে খালামনি খালামনি করে অন্তু চিৎকার করতে থাকে। কেঁদে কেঁদে ঠোঁট ফুলিয়ে ফেলে। উদ্ধত স্বভাবের দীলুকে বদলে যেতে দেখে মনে মনে খুব খুশি হন। অন্তুর সঙ্গে দীলুর এই সার্বক্ষণিক মেলামেশা তার মন থেকে আবেদ হোসেনের চিন্তা সরিয়ে রাখতে অনেকখানিই সাহায্য করবে বলে বিশ্বাস করেন।
অন্তু মাঝে-মাঝে অদৃশ্য হয়ে যেতে বড় পছন্দ করে। সে খাটের তলায় অথবা ঘরের কোনো কোণাকানচিতে লুকিয়ে থাকে। খুঁজে পাওয়া না গেলে সারা বাড়িতে একটা আতঙ্ক ছড়িয়ে যায়, অন্তু কোথায়, অন্তু কোথায়। কোথাও খুঁজে পাওয়া যায় না। খুঁজে খুঁজে সকলে যখন হয়রান, খাটের তলা থেকে অন্তু মাথায় ঝুলকালি মেখে হাসতে হাসতে বেরিয়ে আসে। এই একটুখানি শিশু কত চাতুরি জানে। সকলের দৃষ্টি এড়িয়ে, কোন ফাঁকে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে আসে। একেবারে আঙিনায় বেরিয়ে এসে ফড়িঙের পেছনে ছুটোছুটি করে। হাতের কাছে যা পায়, মুখের ভেতর চালান করে দেয়। একবার একটা আস্ত কেচো মুখ থেকে বের করা হয়েছিল ।
একদিন অন্তুকে পাওয়া গেল না। সবখানে খোঁজা হলো। সবগুলো খাটের তলা দেখা হলো, রান্নাঘরে খোঁজ করা হলো। স্টোর রুম, নিচের অফিস ঘর তন্ন তন্ন করা হলো। না অন্তু কোথাও নেই। সকলেরই একটা প্রশ্ন, অন্তু কোথায়, কোথায় যেতে পারে অন্তু। এই শিশুটি অতি অল্পে যেমন সকলকে আনন্দ দিতে পারে, তেমনি আবার অতি অল্পে সকলকে ব্যতিব্যস্ত করেও তুলতে পারে। কোথাও যখন পাওয়া গেল না নুরুন্নাহার বানুর সহজাত প্রবণতা মনে করিয়ে দিল, যদি অন্তু গোয়াল ঘরে গিয়ে থাকে। সত্যি সত্যি গোয়াল ঘরেই অন্তুকে পাওয়া গেল। কীভাবে এই এতদূর চলে এসেছে কেউ চিন্তাও করতে পারেননি। নুরুন্নাহার বানু দেখেন, অন্তু ছোট ছোট হাতে গরুটির ওলানের বাঁট নিয়ে খেলা করছে। এই দৃশ্য দেখে নুরুন্নাহার বানুর মাথায় রক্ত চড়ে গেল। শেখ তবারক গরুর আকারে তার জীবনের মধ্যে একটা শনি ঢুকিয়ে দিয়েছেন। এই গরুটির কারণে স্বামীর সঙ্গে সম্পর্ক নষ্ট হয়েছে, কন্যাটি বিপথগামী হয়েছে, এখন নাতিটিকেও ধরে টান দিচ্ছে। নুরুন্নাহার বানু চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিলেন, গরুটিকে তিনি ইঁদুর মারা বিষ দিয়ে খুন করবেন ।